উ জ্জ্ব ল পা ঠ । পর্ব ২
২০১৫ সালের দিকে দাহপত্রের টেবিল থেকে একটি কবিতার বই ‘অশুভ মোমবাতি’ সংগ্রহ করেছিলাম। কয়েকপাতা পড়ে ভালো লাগেনি। এরপর আরও একটি বই ‘ইনস্টাগ্রামের বাড়ি’ সন্তুদার থেকে উপহার পাই। এই কবি সম্পর্কে আমার তেমন কোনো আগ্রহ জন্মায়নি। কবি ‘দাহপত্র’ পত্রিকার ঘনিষ্ঠ। ওঁর সম্পর্কে জানতে পারি— ভীষণ খামখেয়ালি একজন মানুষ। কখনোই নিজের লেখা নিয়ে সন্তুষ্ট হন না। সন্তুষ্ট হওয়া তো দূরের কথা, বই ছাপানোর দু-দিন পর সেই বই তুলে নেন। বাইরের পাঠকের কাছে দু-এক কপি পৌঁছালে ফেরত দিতেও অনুরোধ করেন।
কবির নাম নিত্যব্রত দাস। পরিচিত লোকজন ‘পিকুদা’ বলে ডাকেন। আমার সঙ্গে কখনো মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। আশির দশকের কবি। সন্তুদা বারবার বলত, পিকুদার লেখায় একটা নিজস্ব ভাবনা আর স্বর পাওয়া যায়। লেখাগুলো ভীষণ ভাবায়। সত্যি বলতে, আমরা যারা কবিতালেখক ভীষণ লোভী পাঠক। আমরা পাঠের মাধ্যমে বারবার খুঁজি এই লেখা থেকে কী ভাবনা পাব? কী স্বর পাব? কী শব্দ পাব? যা আমাদের লেখার ভাবনাকে উসকে দেবে। আমাদের চালিত করবে নিজস্ব ঘোরের জোনাকিভর্তি একটা অন্ধকার কূপে। একজন কবিতা লেখকের কাছে বইপাঠ অবসর সময়ের বিনোদন নয়। লোভের নিভৃত আশ্রয়।
এবারের ২০২০ এর বইমেলায় কবির দুটো বই প্রকাশ পায়। একটি ‘অন্ধকারবয়সি’, আরেকটি ‘নানা রঙের কাঠের হাত’। কবি সম্পর্কে ততটা আগ্রহ না জন্মালেও দুটো বই-ই সংগ্রহ করি।
লকডাউনে ঘরবন্দি। নানা বইপত্র নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করছি। নিত্যব্রত দাসের ‘অন্ধকার বয়সি’ বইটা একদিন সামনে এল। পাঠ শুরু করলাম। বলা যায় আগে পড়া দুটো বই সম্পর্কে প্রায় ভুলে গেছি। নিত্যব্রত দাস সম্পর্কে আমার অন্ধকার দরজা খুলে গেল। ঘরে প্রবেশ করতে বুঝলাম, এই ঘর এতটাই রহস্যে ভরা এখানে প্রবেশ করতে হলে একটা প্রস্তুতি নিতে হয়। এতটা সময় পেরিয়ে, আবার নতুন করে পুরোনো বইগুলো নিয়ে বসলাম। আমার মাথার মধ্যে বসে গেল ক্ষুধার্ত এক কাঠঠোকরা। ক্রমাগত সে ঠোঁট দিয়ে মাথা ঠোকরাচ্ছে। এই কবিকে নিয়ে কখনো লিখতে হবে। আমার অনেক দিনের ইচ্ছে ছিল, এই ধরণের লুকিয়ে থাকা বা হারিয়ে যাওয়া কবিদের সন্ধান করে কোনো কাজ করার। রাজদীপদার ‘Hello Testing বাংলা কবিতা’ ওয়েবজিনে কবিদের নিয়ে যখন ধারাবাহিক লেখার প্রস্তাব এল, ভাবলাম কাজটা শুরুই করে দিই। কিছুটা হলেও এগিয়ে যাবে।
কবি, চারটে কাব্যগ্রন্থের কোনোটাতেই কোনো কবিতার নামকরণ করেননি। কবিতাগুলো সিরিয়াল নম্বরে রেখেছেন। কবিতার নামকরণ করা আমার নিজের কাছেও মনে হয় খুব কঠিন একটা কাজ। তবে গোটা কাব্যগ্রন্থে সিরিয়াল নম্বরে কবিতা রাখা আরও কঠিন। কাব্যগ্রন্থে, কবি শুধু তাঁর ভাবনা-চিন্তা সাজিয়ে রাখেন না, ধরে রাখেন তাঁর জার্নি। এই জার্নির সুরটা তখনই মসৃণ হবে যখন কবি দক্ষতার সঙ্গে সাজাতে পারবেন কবিতার মালা। নামকরণহীন কবিতা দিয়ে সাজানো কাব্যগ্রন্থ যেন একটিই দীর্ঘ কবিতা… দীর্ঘকবিতা, দীর্ঘ পথের মতো। গন্তব্যে পৌঁছানোই শুধু আমাদের লক্ষ্য নয়। গন্তব্যটা কতটা সুখকর হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হয়।
‘নানা রঙের কাঠের হাত’ কাব্যগ্রন্থ থেকে প্রথমে কয়েকটি টুকরো টুকরো কবিতা প্রথমে পড়া যাক, বিক্ষিপ্তভাবেই—
১
এত ভারী শাড়ি দেখিনি মেলে দেবার পর ছাড়ার আগের মতোই হাওয়ায় এক ফোঁটা দোলে না, এক সন্ধ্যেয় রং ওঠা কাপড়ের বয়স বেড়ে যায় এত, কঠিন হয়, মুখের কথা জমে এত পুরাতন মন্দির হয়ে ঝড় ওঠার আশঙ্কায় বুক কাঁপায়।
২
একটাই চিনেমাটির বাসন। তাতে খাই, স্নান করি
মুখ দেখি, সময় দেখি, বয়স দেখি, গোল হয়ে সারারাত ঘুরি, দেখে ফেলবে ভয়ে
অন্ধকার লুকিয়ে রাখি অন্ধকারে, খারাপ সময় এলে উপুড় করে চাপা দিই একজোড়া
চিনে মাটির হাত দিয়ে।
৩
আমি ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন, একটা সময়কাল। আর, একটা চড়ুইয়ের পূর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি সেই বিপাশায়, যে এসবের মালিক ছিল।
৪
সকাল দশটার পর থেকে বেলা তিনটে পর্যন্ত যে লোকটা বাড়ি বাড়ি গ্রিলের গেট অব্দি গিয়ে দেখা করে আসে, সে-লোকটার নিজের বাড়ি নেই। একটা ঘানি আছে। একটা অল্প দামের সূর্য আছে।
উপরের কবিতাগুলো পড়লেই বোঝা যায় কবির স্বর কতটা স্বতন্ত্র। কবির দর্শন ও ভাবনার জগৎ কতটা আলাদা। কবির থেকে শেখা যায় কম কথায় কবিতাকে কতটা তীক্ষ্ম করা যায়। অণুকবিতার জোয়ারে একটা বড়ো বাক্যকে ভেঙে দু-তিন টুকরো করে যেভাবে কবিতা লেখার প্রয়াস দীর্ঘ দিন চলছে, তাতে বোধহয় বেশি করে এই কবিতাচর্চার প্রয়োজন। কবিতাগুলোয় দেখা যায়—আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনের নানা চিত্র। ক্লান্তিহীন ঘন বিষাদ। প্রথম কবিতাতে উঠে এসেছে ‘চিনেমাটির বাসন’। কবি বলেছেন, চিনেমাটির বাসনে ভাত খান, স্নান করেন, সময় দেখেন, বয়স দেখেন… চিনেমাটির বাসনে আলো পড়লে তার Reflection ঘটে। কবি সেই আলোতেই দেখেন মুখ। দেখেন জীবনের নানা প্রতিচ্ছবি। এমনকি অন্ধকারও লুকিয়ে রাখেন। কবিতাটি পড়তে পড়তে দেখা যাচ্ছিল নানা ছায়া-আবছায়া। শেষ লাইনে এসে কবিতাটি হয়ে উঠল কোনো জাদুকরের মুগ্ধ করা রহস্যজাল। আমরা এই রহস্য দেখব বলেই তো কবিতার কাছে নতজানু হয়ে থাকি। লাইনের পর লাইন এগোতে থাকি। শেষ লাইনটা একবার ভাবুন, “খারাপ সময় এলে উপুড় করে চাপা দিই এক জোড়া চিনেমাটির হাত দিয়ে।”!!!
আরেকটি কবিতায় কবি বলেছেন— “ভাড়া নিয়েছিলাম একটা জন্মদিন” । পরের লাইনে বলছেন— “একটা চড়ুইয়ের পূর্ণ মালিকানা চেয়ে উচ্ছেদ হয়েছি সেই বিপাশায়, যে এসবের মালিক ছিল।” খেয়াল করা যায় কবির কথন খুব সহজ সরল। কিন্তু তাঁর ভাবনা ও দর্শন অনেক গভীরে। কবি কেন জন্মদিন ভাড়া নেওয়ার কথা বলছেন? জীবনের কাছে আমাদের অনেক ঋণ। তার কতটুকুই বা আমরা পরিশোধ করতে পারি? চড়ুই পাখির মতো আমরা কি পারিনা ফুড়ুৎ করে এদিক-ওদিকে উড়ে যেতে? বিপাশার জলে ঝাঁপ দিয়ে শাপ মুক্তি হয়ে আবার জন্ম নিতে? নদী সবসময় আত্মসাৎ করে না, অনেক সময় ভরিয়ে দেয়। পুরাণে কথিত বশিষ্ঠ মুনির সেই কাহিনির মতো। বিশ্বামিত্রের চক্রান্তে বশিষ্ঠের শত পুত্র নিহত হয়। তিনি ভেঙে পড়েন। বলা যায় শোকে উন্মাদ হয়ে যান। তিনি নিজের হাত পা বেঁধে ঠিক করেন নদীতে ঝাঁপ দেবেন। না, কিন্তু নদী তাকে মৃত্যুর পরিবর্তে দিল নতুন জীবন। কবি বোধহয়, এই ভাড়া করা জন্মদিন নিয়ে বিপাশায় ডুব দিতে চান।
‘অন্ধকার বয়সি’ কাব্য গ্রন্থ থেকে একটি কবিতা পড়া যাক—
ছোটো বেলার বাড়ি ছিল আমাদের অনেক দূরে। বিমলা
কখনো-সখনো আসত, আসত রঙিন কাগজের রিকশায়, কাচ ছেটানো
পুকুরে স্নান করত। বৃষ্টির ফোঁটা সেদিন করাঘাত ছিল।
শূন্য নারকেল মালায় টলটল করেছে সমুদ্র। সারারাত কারা মাছ ধরত,
মাটি আঁচড়াত কুকুর, শুয়ে শুয়ে শুনতাম।শোনা যেত মাটির বারান্দায়
খালি বিষের শিশিগড়ানোর শব্দ। এক শীতলা মূর্তি সেদিন কত
পরিচ্ছন্ন রেখেছে অন্ধকার বাঁশতলা।
উপরের কবিতার চিত্রকল্প আমাদের অচেনা নয়। আসলে আমাদের জীবন একই। সেই শৈশব, যৌবন, প্রেম, সংসার, ব্যাধি… কিন্তু প্রত্যেকের জীবনের আলাদা আলাদা বাঁক থাকে। জীবন সেখানেই বৈচিত্র্যময়। কবিতার ক্ষেত্রেও সেই একই ব্যাপার ঘটে। কবি, তাঁর নিজের দেখাকে শব্দ ও ভাবনার নিগূঢ়তায় কতটা গতিশীল ও প্রাণবন্ত করতে পারছেন, সেখানেই যেন কবিতার সারবত্তা। আমাদের অস্তিত্বের মধ্যে অজস্র মৃত ঘাস পড়ে থাকে। একটু আলো পেলেই সে আবার জেগে উঠবে। কিন্তু সেই আলোর সন্ধান না করে আমরা নিজেদের পায়ে তা পিষে দিই। নিজেরাই ভুগি অস্তিত্ব-সংকটে। কবি লিখছেন, “বিমলা/ কখনো-সখনো আসত, আসত রঙিন কাগজের রিকশায়, কাচছেটানো/ পুকুরে স্নান করত।” কবিতাটি আমি হয়ত ভুলে যাব কোনোদিন, ভুলব না তাঁর এই শব্দদুটি ‘রঙিন কাগজের রিকশা’, ‘কাচ ছেটানো পুকুর’। এ-কবির একেবারেই নিজস্ব। ওই যে আগেই বলেছিলাম— কবিতা লেখক আমরা, লোভী পাঠক। এই লোভের বশেই নতুন নতুন কবিতার সন্ধান করে চলা…
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অশুভ মোমবাতি’ থেকে পড়া যাক একটি কবিতা—
যে মেয়ের নাক ছোটো চোখও তার
বনবেড়ালির মতো, নাকের ওপরেই থাকে তারা
শরীর ঝুঁকে থাকে শিকারে
কাপড়ের পুঁটুলিতে কাচটিপ, কেটলি,
জল গরম করার জ্বালানি, জামাকাপড়, সন্তানসন্ততি
মশারি উঠিয়ে সঙ্গে নামে আরও হাজার বেড়াল
অনেক স্বামীর একজন গাছতলা দিয়ে হাঁক দিতে দিতে ফেরে,
‘ফটো বাঁধানো হলনা’
কাপড়ের পুঁটুলি থেকে একের পর এক
শিকারি বেড়াল বাগানের আলোয় এসে
ছোটো ছোটো চোখ, তাদের ছোটো ছোটো নাক নিয়ে
মত্ত হয়ে ওঠে নতুন নতুন শিকারে
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১৫ সালে। একজন আশির দশকের কবির কবিতা প্রকাশ হচ্ছে প্রথম দশকের মাঝামাঝি সময়ে। একজন কবির এই আত্মগোপন কতটা জরুরি তা কবিতাটি পাঠ করলে বোঝা যায়। একটি কবিতাকে কোনো পাঁচমাথার মোড়ে এসে ছেড়ে দেওয়া প্রয়োজন। হয়ত সচেতন ভাবে কবি সবসময় পেরে ওঠেন না। পাঠক নানা জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকে। কবিতা নিজে কোনো মোড়ে না গিয়ে যদি পাঠকই নিয়ে যায় নিজ নিজ রাস্তা ধরে, তাহলেই তো কবিতার সার্থকতা। কবিতা যত বহুস্তরীয় হয়ে উঠবে এই রহস্য তত আলো ফেলবে। উপরের কবিতাটি পড়তে গিয়ে বার বার মনে হয়েছে এই বহুস্তরীয় কবিতাটি নিয়ে নানা ভাবে ভাবতে। ওই যে প্রথমে বলেছিলাম— প্রথম পাঠে ভালো লাগেনি। আসলে এই বহুস্তরীয় কবিতার কাছে পৌঁছানর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার তা ছিল না। এখনও হয়ত ঠিকঠাক প্রস্তুতি হয়নি। কবিতাটির কোনো ব্যাখ্যাতে না গিয়ে শুধু বলতে পারি— ওই শিকারি বেড়ালের মতো আমিও ওত পেতে থাকি নিত্যব্রত দাসের কবিতার দিকে। ছোটো নাকের ফুটো দিয়ে নিই তার ঘ্রাণ।
‘ইন্সটাগ্রামের বাড়ি’ কাব্যগ্রন্থটি পড়ার সময় মাথায় বারবার পাক খাচ্ছিল ‘গঙ্গা’ চরিত্রটি। গঙ্গা কে? রক্ত-মাংসের কোনো নারী না বয়ে যাওয়া বিপুল জল রাশি? কবি এক জায়গায় বলেছেন— “বন্ধ্যা অপবাদ ভেঙে আদিগঙ্গার কোল জুড়ে খেয়ায় ভাঙবে/ নতুন গঙ্গার ঢেউ?” কবিতার শব্দ Duality কবিতাকে তাঁর নিজ অবস্থান সরিয়ে আরেক উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারেন যদি কবি তাঁর মুন্সিয়ানায় ক্লান্তিহীন সিঁড়ি ভাঙতে পারেন। অনেক কবিতায় দেখেছি— ফিকে শব্দ Duality কবিতাকে যতটা শরীর দিয়েছে ততটা প্রাণ দেয়নি। কবিতায় অলংকারের ব্যবহারের মতো।
এখন এই কাব্যগ্রন্থ থেকে পড়া যাক কিছু কবিতা—
১
খবর এসেছে দ্বিধা এখানে আসেনি যেমন, কোথাও আসেনি।
দ্বিধা কোথাও আসেনি। দ্বিধা গলায় সোনার হার পরে। দ্বিধাকে সহজে
চেনা যায় তাই। যখন লতার নিচে, বারান্দায়, হাইওয়ের চটিতে।
তবু দ্বিধা যে আসেনি, তার কারক সম্ভবত দ্বিধা নিজে ছিল না।
তার মানে সে এসেছে, পৌঁছোয়নি। আফশোস করে ফিরে গেছে যে
গতকালটাই ঠিক খুঁতহীন ছিল, আজ নয়। তার আগের দিনগুলোও
খুঁতহীন ছিল না বিশেষ।
এটা না হওয়াই খুব স্বাভাবিক যে, দ্বিধা এলো, সটান ঢুকে পড়ল ঘরে,
আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ল সীতারা।
২
শ্যামেদের পাড়ায় নতুন কল বসেছে। নতুন জল বসেনি।
কল ঢাকা পড়ে গেছে পাতার অনন্তে। কথা ছিল কল বসবে,
জলের স্ফটিক দেখে মৃগেল বসবে। তার অন্য সহচর।
পাতায় এখন ঢাকা পড়ে এই, তো হাওয়ায় উড়ে যায় সমান বেগে।
একসময় পিছিয়ে যায় হাওয়ার বেগ। মৃত পাতার নতুন কল বসে।
মুখ খোলে না শ্যাম। সারা গায়ে মাছি, মন্থরপায়ে অফিসে যায় শ্রাবণমাসে।
৩
পাশের ফ্ল্যাটের গঙ্গা মারা গেল কয়েক বছর হলো।
মেঝেতে অনেকদিন ছড়িয়ে রইল গঙ্গার ভিজে পা, জলের বালতি,
শায়ার লেস, কোলাপসিবল গেটে আটকে। আর তার আধখাওয়া
হাওয়াইয়ে পরপুরুষের পা গলিয়ে থাকার লোভ জানাজানি
হয়ে গেল চারমুখে।
ও বেঁচে থাকতে যে টুকটুক শব্দ বন্ধ দরজার পেছনে ঘুরত,
সে তবে ছিল দেশলাই ঠুকে প্রদীপ জ্বালাবার? মরে যাচ্ছে
পরপুরুষ যে, তাকে উল্টোচিতায় পুড়িয়ে জাগিয়ে রাখার মোমবাতি?
আসলে সে কি তবে নিরন্তর বৃষ্টি ছিল, আচার অনাচারের, কূল অকূলের
নিরন্তর যুদ্ধের অবৈধ স্মৃতি? এক শতাব্দী পরে ফাঁকা ঘরের
দরজা খোলার খাঁ খাঁ করা মোমবাতির আগুনের সূচনা?
৪
আমার সঙ্গে হাসতে হাসতে সিঁড়ি ভেঙ্গে উঠে এল সত্যবতী।
হাসি না থামিয়ে ঢুকে গেল উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে,
চটি ভেঙে রইল গোড়ালিতে।
ছাদের তারে কাপড় উল্টে সময় কাটিয়ে পা টিপে নামতে
গিয়ে দেখি চারতলায়, তিনতলায় ফ্ল্যাটের মুখে পা থেকে খুলছে
একটা একটা ফোস্কাপড়া চটি,
খালি পায়ে খ্যাপার মতো সত্যবতী ঘুরছে।
টোকা দিয়ে নামিয়ে আনছে সিঁড়ি, এতলা ওতলার বাদুড়।
জঙ্গল হয়ে যাচ্ছে দুখানা চোখ, ভেঙে ফেলছে আগের হাসি হাসি ভাবখানা।
এই ধারাবাহিকের মূল উদ্দেশ্যই কবির কবিতার সঙ্গে পাঠকের যোগাযোগ ঘটানো। কোনো কবিতাবোদ্ধা বা আলোচক আমি নই। আমার পাঠানুভূতিকে পাঠকদের সঙ্গে সংযোগ ঘটিয়ে যদি কবিতার নানা টুকরো-টাকরা দিক পাঠককে ভাবাতে পারে বা কবিতা সম্পর্কে আগ্রহ যোগান দেয় তাহলেই সার্থক।
নিত্যব্রত দাসের কবিতা পড়লে বারবার আমার মাথায় আসে অমিতাভ মৈত্রের কথা। দুই কবির কোথাও যেন একটা মিল পাই। ভাবনার মিল। কিন্তু দু-জন দুই পথে হাঁটেন। স্বতন্ত্র ভাবেই হাঁটেন। অমিতাভ মৈত্র আটপৌরে জীবনের কথা লেখেন না। তিনি লেখেন বাংলায় দাঁড়িয়ে এমন কবিতা যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে মনে হয় সেই দেশের কবিতা। কিন্তু নিত্যব্রত দাস দেখেন আটপৌরে জীবনের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম নানাদিক। ভীষণ সচেতন ভাবে। রহস্য রেখে। আড়াল রেখে। সহজ ভাবে। দর্শনে। অমিতাভ মৈত্রের কবিতায় আসে ম্যাডাম এম, খ্রিস্টোফার, হেনরি, মায়েস্ত্র। আর নিত্যব্রত দাসের কবিতায় আসে বিমলা, গঙ্গা, সত্যবতী। এরা বাংলার মেয়ে। পাশের পাড়ার, পাশের বাড়ির মেয়ে। এই মেয়েগুলোকে কৈশোরে আড়চোখে দেখেছি। দেখেছি পরবর্তীতে ঝুলে যাওয়া স্তন নিয়ে স্বামীর সংসার করতে। দুরন্ত বাচ্চাকে উচ্চ স্বরে খ্যাঁকাতে। কখনো বা শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করতে।
শূন্যতা আমাদের একা রেখে চলে যাচ্ছে। শূন্যতার সঙ্গে আমরা করতে চেয়েছি ঘর। এই ঘর, আমাদের চাঁদ না দিক, দিক জোছনার চঞ্চলতা অথবা মেঘের তীব্র গর্জন। ডানা ভেজা শালিখের মতো ঝাপটাতে ঝাপটাতে আমরা যেন শরীরের সমস্ত জল ঝেড়ে ফেলতে পারি। পারি— শরীরের উষ্ণতায় মনকে স্নান করাতে। আমাদের বালিশ ভিজে যাওয়ার আগেই ছিঁড়ে গেছে। এতে কার দোষ? মাথা না বালিশের? ওয়াড়ের নালে লাল জোনাকি রক্ত খেয়ে লাল আলোতে ভরিয়ে দেবে এই ভাবনার মৃত্যু নিয়ে যদি আবার গ্রহণ হয় তবে কাকে প্রথম পাশে পাব? কবিকে না কবিতাকে? এই যে যত দিন যায় মনে হয়, কী লিখছি? বা কোনো বই পড়লে ধুস কেন সময় নষ্ট করে পড়লাম। আসলে কি অন্ধত্বের স্লোগানে মিছিলের প্রথম সারিতে উপনীত হয়েছি না আমার মিছিলে একাই একটা রাষ্ট্রের পতাকা বাহক হয়ে ভিতরে ভিতরে কবিতার দ্বন্দ্ব তৈরি করছি? এখুনি মিছিল শেষে যদি সন্ধ্যা নেমে আসে, আলো কোথায় পাব? আমরা আবার ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নেব? না একটা ‘অন্ধকারবয়সি’ আমি ‘অশুভ মোমবাতি’ জ্বালিয়ে নিজের মাথায় হাত বুলিয়ে দেব ‘নানা রঙের কাঠের হাত’ দিয়ে? না এই আমার ‘ইন্সটাগ্রামের বাড়ি’?
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ:
অশুভ মোমবাতি (২০১৫)
ইন্সটাগ্রামের বাড়ি (২০১৬)
নানা রঙের কাঠের হাত (২০১৯)
অন্ধকার বয়সি (২০১৯)