উ জ্জ্ব ল পা ঠ । পর্ব ৩
১
আমার দীর্ঘদিনের অভ্যাস— কেউ মারা গেলে তাঁকে ফেসবুক থেকে আনফ্রেন্ড করে দেওয়া। প্রিয় কবি, পছন্দের কবি নিয়ে ফেসবুকে মাঝেমাঝে তর্ক-বিতর্ক দেখি। এ ধরনের তর্ক-বিতর্ক হাসির খোরাক ছাড়া কিছু না। ‘প্রিয়’ শব্দটা ভীষণ রাজনৈতিক ও সন্দেহজনক। তবু এ নিয়েই আমাদের চলতে হয়। লিখতে আসার শুরু থেকে আজ অবধি অজস্র কবি পছন্দের তালিকায় এসেছেন বা পছন্দ থেকে দূরে সরে গেছেন। এখানে কোনো রাজনৈতিক বা সন্দেহজনক কিছু থাকলেও থাকতে পারে। তবে প্রধান যে কারণ, তা হল— আমি লিখতে আসার শুরু থেকে আজ অবধি কীভাবে নিজের পাঠকসত্তাকে চালিত করছি। কোন পথে যেতে চাইছি। সেই পথে যেতে যেতে কোন গাছ, কোন পাহাড় দেখছি, সেগুলো আমার মনে কীভাবে প্রভাব বিস্তার করে তার ওপর নির্ভর করে অনেকটা। যাইহোক, আবার শুরুতে ফিরে আসি। মৃত্যুর পর এক ব্যক্তিকে আমি আনফ্রেন্ড করে দিই। জানতাম লেখালেখি করেন। লেখা সেভাবে পড়া হয়নি। কোনোদিন ইনবক্সেও কথা হয়নি। ফেসবুকে তিনি সম্ভবত কোনো লেখাও পোস্ট করতেন না।
২০২০-তে আমাদের ফোরামের লিটল ম্যাগাজিন মেলায় ‘হাওয়াকল’ প্রকাশনীর টেবিলে চমৎকার একটা জেল জ্যাকেটের বই নজর কাড়ে। ছবি দেখেই মানুষটিকে চিনতে পারি। টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই বইটির কয়েকপাতা পড়ে ফেলি। নিজের মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করতে শুরু করল। কেন এই মানুষটির কথা আগে জানতে পারিনি। বইটি কিনে নিই। কবি রিমি দে খুব গুছিয়ে বইটির সম্পাদনা করেছেন। এই কবির নাম সমর চক্রবর্তী। শিলিগুড়ি বাড়ি। শিলিগুড়ি কলেজেই অধ্যাপনা করতেন। ইংরাজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সুবীরদার (সরকার) সঙ্গে কথাসূত্রে মানুষটির সম্পর্কে কিছুটা জানতে পারি। সত্তর দশকের এই কবি, শিক্ষক হিসেবে ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন। সম্পাদিকা, ভূমিকাতে বলেছেন— “আমরা যারা খুব কাছ থেকে সমরদাকে দেখেছি, চিনেছি কিংবা পারিবারিকসূত্রে জেনেছি ওঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলি, টের পেয়েছি যে শিশুর সারল্য বুকে রেখে গার্হস্থ্য প্রেম ও প্রবল ঔদাসীন্য লালন করতেন একইসঙ্গে। সংসারে থেকেও অসংসারী আবার বাউল হয়েও অসম্ভব গৃহী। এমন মানুষ খুব কম দেখা যায়”।
২
সুর সম্পর্কে একদম আনকোরা আমি। তবু অনেকসময় নানারকম গান শুনি। তার ভাষা বুঝি বা না-বুঝি। কান শান্তি পাচ্ছে। মনের ভিতর কোথাও যেন মৃদু বাতাস বইছে টের পাই। কিছু কিছু কবির ক্ষেত্রে দেখা যায়, তাঁর ভাষা বা ভাবনাকে ধরতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু কবিতার মধ্যে থাকা কোনো একটা সুর কবিতার প্রতি আসক্ত করে তুলছে। এই আসক্ত করে তোলার ক্ষমতা সব কবির থাকে না। কেউ কেউ পারেন। তবে কবিতার সুর অনেকসময় কবিতার ভাবনাকে নষ্ট করে। কবি সমর চক্রবর্তীর নির্বাচিত কবিতা পড়তে গিয়ে বারবার ওঁর সুর আমাকে আবিষ্ট করেছে। বাংলাভাষায় ক’জন কবি কবিতার সুর নিয়ে ভাবেন জানি না। তবে কবি সমর চক্রবর্তীর কবিতার সুর যেন কোনো উচ্চাঙ্গ সংগীতের। হলভর্তি মানুষ গমগম করছে, কিন্তু কোনো হইহুল্লোড় নেই। শুধু হলের দেওয়ালে দেওয়ালে শিল্পীর গলার আওয়াজ ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে কানে। কান আরও প্রসারিত হচ্ছে ওই আওয়াজ সম্পূর্ণ ধারণ করতে। কবির কাব্যগ্রন্থগুলি পড়লে আমরা হয়ত সেটা টের পাব। ধীরে কবির নানা কবিতা পড়ব।
কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘শিলা কিংবা শৈলীবিষয়ক’। প্রকাশ হয় ১৯৯৭ সালে। ওই বইয়ের নাম কবিতাটা পড়া যাক—
“পাথর এত তরল হতে জানে
শব্দবিহীন ছন্দোমহান মানের
টানে নেচে উঠল পাথর
হঠাৎ গূঢ় জন্ম রটে গেল
গুহার মধ্যে আকাশফাটা আলোর
ভালোবাসায় ভাসে পাথর
পাথর কুঁদে ঠিকরে নিলে ঝলস
তাকে তোমার খিদের কথা বলো
তাকে তোমার শীতের কথা বলো
মাঠের মাঘে ফুটিয়ে তোলা পলাশ
পাথর এখন উপুড়কলস
গানে”
এই কবিতার একটা অন্ধকার ও একটা আলোর দিক আছে। সেই অন্ধকার এত ঘন হয়েও তাৎক্ষণিক। বরং আলোটাই ছড়িয়ে পড়ে। ভালোবাসায় যে পাথর ভাসে যেখানে আমাদের জমাট হতে বলে। আমাদের শীত, খিদেকে হয়ে উঠতে বলে মাঘের মাঠের পলাশ। মাঠের নীরবতা নয়, মাঠের প্রশস্ততায় যেন সমস্ত পাথর গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যায়। আমরা তরল হয়ে পাথরের সঙ্গে ভাসি।
আমরা কবিতা লিখি না জীবন লিখি? কবিতা জীবনকে কোন আয়নার সামনে দাঁড় করাই? সেই আয়নায় কি আমরা নিজের মুখ দেখি? নাকি কেউ এসে সেই আয়নায় ভিড় জমাবে বলে সমস্ত ধুলোবালি সরিয়ে জমাট করি ধুলোবালি? ‘ভাষা দুই’ শিরোনামে তিনি একটি কবিতা লিখেছেন। কবিতার মধ্যে একটি লাইন আছে— “দ্রব মেদিনীর কষ্টে বর্ণবিভেদের আঁকাবাঁকা”। লাইনটি নিয়ে ভাবছিলাম। কবি কেন এভাবে লিখলেন? লাইনটি কি কোথাও আমাদের আঘাত করছে না? পরের লাইনে লিখেছেন— “শানে বাঁধা ঘাটের চকিত শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা”। পরের লাইনে এসে বোঝা গেল কবিতায় তাঁর এই শব্দপ্রয়োগ জোরপূর্বক নয়। স্বভাবোচিত। আর এখানেই বোধহয় নিজস্ব মুন্সিয়ানা। ‘শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা’ এই শব্দ আমি কোনোদিন ভুলব না। কবিতা লিখতে এসে মনে হয়— একটি পুকুরই যেন আমার অবস্থান। চারিপাশে শ্যাওলাঘেরা। আমি মাঝখানে সাঁতার কাটা, মাঝেমধ্যে ডুব দেওয়া কোনো হাঁস। নিজের ডানার জল ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিজেকে আবার করে তুলছি জলেরই কোনো আপনজন। কবিতাটা পড়া যাক—
“একদিন কবিতা লিখেছি এখন আমাকে লিখি জলে
ধুয়ে যাই ছুঁয়ে যাই তারও
আগে কালো নীল ফিকে গাঢ় কাদা
দ্রব মেদিনীর কষ্টে বর্ণবিভেদের আঁকাবাঁকা
শানে বাঁধা ঘাটের চকিত শ্যাওলাশিথিল সীমারেখা
এতদিন কবিতা লিখছি এখন জীবন লিখি জলে”
“চুপ! কোনো শব্দ নয় আমাদের পাপ ভেঙে যাবে।” এক পংক্তির এই কবিতাটি প্রথম কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা। একটা লাইন কীভাবে একটা গোটা কবিতা হয়ে উঠতে পারে তা আমরা এই কবিতাটি পড়লেই বুঝতে পারি। কবিতা তো এমনই তীব্র হওয়া দরকার। যা আমাদের ফালা ফালা করবে। আমরা আমাদের ওই ফালা ফালা বুক নিয়ে বিনা ব্যান্ডেজে কোনো ভোরে উঠে দেখব আমাদের চেনা নতুন সূর্য। চুপ থাকতে থাকতে চুপকথার রাজ্যে আমাদের ধনসম্পদ, মনোসম্পদ, বাক্সম্পদ ক্রমশ লুঠ হয়ে যাচ্ছে। আমরা এই দৃশ্য দেখতে দেখতে নতুন দৃশ্যে ঢুকছি। যেন আমাদেরই আঁকার খাতা। আমরা নিজেরাই আঁকছি। আঁকা শেষ হলে নিজেরাই ‘ভেরি গুড’ দিচ্ছি। তীব্র ব্যঞ্জনাময় এই একলাইন যেন আমদের চোখের সামনে আঙুল এনে বলে দেয়, “রাজা তোর কাপড় কোথায়?”
কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘পাঠ ও পতনের কবিতা’ থেকে কয়েকটি কবিতা পড়া যাক—
দূরত্ব
তবু সব দেখতে পাচ্ছি সামনে রাত্রিনগ্নিকার শব
তার কালো অনিশ্চিত ঢেউ
পেছনে রঙিন চরাচর
এই থীবস্ ওই চাঁপাগাছ দূর সরযূর রেখা
দেখতে পাচ্ছি আরও দূরে
শিল্প হয়ে ঝরে পড়ছে নিহত চোখের যত বালি
সন্ধিকালীন
একটা সরু সাঁকোর মতো বিপজ্জনক বিকেল
টলতে টলতে ঢলে পড়ল মিথ্যেসখীর দিকে
তখন থেকে শুরু হলাম তখনই কল্পিত
জলের ওপর এঁকে দিলাম জীবন্ত জলপিপি
তার মানে তো অভিজ্ঞতা সত্য এবং সরল
ঠিক জানি না মিথ্যেসখী এবার আমায় ধরো
আর যা বাকি সন্ধিকালীন হোক তা জনান্তিকে
আজ ঠিক রবিবার নয়
আজ ঠিক রবিবার নয় আজ বিধিবহির্ভূত ছুটি
সূর্য আজ ভোরে উঠেছেন তারও আগে ওঠা যায় না বলে
সমুদ্র আমাকে দেখতে নার্সিংহোমের কুণ্ঠিত বাগানে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে
আমি তার পৃথুল হৃদয়ে নিজেকে প্রোথিত করে
সূর্য স্পর্শ করি
আমার শরীর থেকে বাকলের ছায়া খসতে থাকে
ন্যূনতম
একেকটি চুম্বন মানে একেকটা মৃত্যুর কথামুখ
তাই চুম্বনের আগে কিছুটা বয়ঃস্থ হয়ে নিতে হয়
তা না হলে মরতে চাওয়ার ন্যূনতম অধিকার জন্মাতে পারে না
দেখো সাবালক জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে জল ও বাতাস
তীব্রতর হয়ে উঠছে জনদুপুরের আত্মগ্লানি
তোমার ঠোঁটের দিকে মুগ্ধ পিপাসায়
নেমে আসছে এই তুচ্ছ মননশীলতা
আমার প্রপন্ন প্রেম আর্ত আর্দ্র মরণশীলতা
তুমি কি প্রস্তুত আছো মুখমদে মিশিয়েছ বিষ
প্রসঙ্গ
জনদুপুরের জন্য এতটাই তুলে রেখেছিলে!
রাস্তায় আত্মার গ্লানি গায়ে মেখে এঘরে এসেছি।
রিসিভার নামিয়ে রেখেছো,
অনুসঙ্গসূত্রগুলি বিচ্ছিন্ন করেছো একে একে—
এবার প্রসঙ্গ হয়ে ওঠো,
যেমন একান্ত জল
আত্মঘাতী সাবানের কাছে।
আগের পর্বগুলিতে আমি বারবার বলেছি, আবারও একই কথার পুনরাবৃত্তি করছি। এই ধারাবাহিক কোনো গবেষক বা আলোচকের না। এই ধারাবাহিকটা শুরু করেছি— কবির কবিতার সঙ্গে পাঠকদের সংযোগ ঘটানোর উদ্দেশ্যে। চেষ্টা করছি যত বেশি সম্ভব সম্পূর্ণ কবিতা লেখাটির মধ্যে রাখতে। কবিতার ব্যাখা আমার কাছে মনে হয়ে সবুজ মাঠে পড়ে থাকা শুকনো ঘাসকে পিষে দেওয়া অবহেলার মতো। সবুজ মাঠে যখন বিচরণ করছি, তরতাজা ঘাস না ছুঁয়ে শুকিয়ে যাওয়া ঘাস মাড়াব কেন? তাছাড়া বহুমুখী কবিতার ‘বহুমুখ’ থাকবে। প্রতিটি পাঠক নিজ নিজ পাঠে রহস্যসন্ধান করবেন। নিজের মতো করে খুঁজবেন আলো। তাই কোনো আলোচনায় না গিয়ে লেখাটির মাধ্যমে কবির গতিপথ বোঝার চেষ্টা করব। উপরের পাঁচটি কবিতা যদি আমরা গভীরভাবে পাঠ করি, কবি সম্পর্কে ধারণা আরও স্পষ্ট হবে। ‘কবিতা বিষয়ক ভাবনা’ শীর্ষক একটি গদ্যে নবনীতা দেব সেন বলেছিলেন— “কবিতা আমার নাড়ির সঙ্গে জড়ানো কবচকুণ্ডল। কবিতা আমার অভিমান, আমার প্রার্থনা, আমার নিঃসঙ্গতা, আমার সঙ্গ, আমার পূর্ণতা, আমার অতৃপ্তি। চিরকালের পথে সে নুপূর হয়ে জড়িয়ে থাকে। যে কবিতা ফুরোয় না, আজ পর্যন্ত তেমন কবিতা কি লিখতে পেরেছি? জীবনের প্রত্যেকটি কবিতাই বোধহয় সেই কবিতাকে খোঁজার চেষ্টা। একটু পর্দা, একটু আব্রু, কিছুটা রহস্য থাকা চাই। এটা কবিতার অত্যাবশক ধর্ম। “দেখা না দেখায় মেশা” বধের অতীত এক বিদ্যুৎলতার উপস্থিতি চাই কবিতার “দ্য লা ম্যুজিক আভঁ ত্যুলে শোজ” সবার আগে সংগীত। তখন ভাষা তো সংকেত, ভাষা তো এক বুনো ঘোড়া। তাকে পোষ মানিয়ে জ্বলন্ত আগুনের রিঙের মধ্য দিয়ে তালে তালে লাফ দেওয়ানোর নাম কবিতা।” কবি সমর চক্রবর্তী সেই কবিতা সন্ধানেই ভাষাকে বুনো ঘোড়া করেছেন। তিনি অস্থির হয়ে কেমন যেন স্থির হয়ে থাকেন। তিনি দেখেন শিল্প হয়ে ঝরে পড়া নিহত চোখের বালি। দেখেন রাত্রিনগ্নিকার শব। অনিশ্চিত কালো ঢেউগুলো। তিনি সরু সাঁকোর মতো বিপজ্জনক বিকেলে টলতে টলতে ঢলে পড়েন মিথ্যেসখীর দিকে। নার্সিংহোমের কুণ্ঠিত বাগানে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা সমুদ্রের পৃথুল হৃদয়ে প্রোথিত করেন নিজেকে। একি মৃত্যুচেতনা নয়? নাকি তাকে বশ করে তারই সঙ্গে করতে চাইছেন ঘর? সেজন্যই কি তিনি বলে ওঠেন— “একেকটি চুম্বন মানে একেকটা মৃত্যুর কথামুখ/ তাই চুম্বনের আগে কিছুটা বয়ঃস্থ হয়ে নিতে হয়/ তা না হলে মরতে চাওয়ার ন্যূনতম অধিকার জন্মাতে পারে না”। কবি প্রেমিক মানুষ। প্রেম তাঁর কবিতায় এসেছে জোছনার মতো। আমরা সেই জোছনায় কনকনে ঠান্ডার দিনেও স্নান সেরে নিতে পারি। আমাদের রোমকূপের মধ্যে যে ভয় সংঘবদ্ধ হয়ে কালো হয়েছিল, তা এতটাই শাদা হয়ে ওঠে আমাদের মনে, শুভ্রতার সারি সারি বালি চিকচিক করে। জল হয়ে ওঠে সমস্ত ভয়। আত্মঘাতী হওয়া সাবান তার ফেনায় হাজার হাজার পৃথিবী তৈরী করে। আমরা নিজেরাই যে ঠিক করে নিই কোন পৃথিবী আমার?
কবির তৃতীয় ও শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ অপড়া অবাক্প্রতিমারা’ থেকে একটি কবিতা পড়া যাক—
ডাক
আমাকে ভেতরে ডেকে নিও যখন সময় হবে জল
যখন স্নানার্থী কোলাহল থেমে যাবে
তখন একবার বোলো বেলা হল এখনও আসবে না
দুপুরের করুণ হলুদ বাবলার আঁচড়ে চিরে গেছে
গভীর গাভীর কাছাকাছি কিছু কিছু চর ও অচর
আগেভাগে বিকেলে ঝুঁকেছে
একটু দূরে জারুলপুরের আকাশ ধুলোর মতো রঙ
ডাহুকের ডাক বেয়ে বেয়ে এই মাঠে বড়ো হচ্ছে ছায়া
সরু হয়ে নিবে আসছে নদী
বেলা যায় আমিও কি যাই
ভেতরে ভেতরে জড়ো হই নদীর নিঃশ্বাস কেঁপে ওঠে
কবির কবিতায় একাধিক বার জলের প্রসঙ্গ এসেছে। জলের প্রতি মোহ কেন? জল কি কেবলই বিষাদব্যঞ্জনা? আমি নিজেও জলের মোহে বারবার ছুটে যাই। ঘণ্টার পর ঘণ্টা নদীর পাড়ে বসি। দেখি কচুরিপানার আবদ্ধ ছোটো ছোটো ঢেউগুলো কীভাবে ধাক্কা মারছে একে অপরকে। ওদের কি টিকে থাকার লড়াই আছে? পাড়ে পৌঁছানোর তাড়া আছে? নিজেকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছি। নদীর কাছে কৈফিয়ৎ চাইনি। জলের শরীরে কখনো কখনো হাত বুলিয়ে দেখে নিতে চেয়েছি সে কতটা মাতৃত্বময়। সে আমাকে অদ্ভুত যৌনতা দিয়েছে। শরীরহীন আমি শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন শরীরে শুধুই জলের নরম দাগ রেখেছি। আমার বিষাদ, আমার উচ্ছ্বাস সবুজ হয়ে উঠেছে। যেন মনে হয়েছে কোনো গাছ জন্ম নিয়েছে। কবি সমর চক্রবর্তীও কি তেমনটা অনুভব করতেন? কেন জানি না প্রথম লাইন পড়ার পর আমার আর এগিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় না। মনে হয়েছে ওই লাইনটিকেই আঁকড়ে ধরে থাকি। আমি নিজেও এমনটা বলতে চেয়েছি। বলতে চেয়েছি কবির মতোই— “আমাকে ভেতরে ডেকে নিও যখন সময় হবে জল”।
এই কাব্যগ্রন্থ থেকেই পাঠের জন্য রইল আরেকটি কবিতা—
বিন্দুবিসর্গ
বিসর্গ পর্যন্ত যাই
বিন্দু থেকে রিসর্ট বিষাদ
কার বালা কার মালা গলায় পরেছ
যেন তা জানার জন্য যা-না-জানা তার নীল
ডানায় ওড়াই
আমার ব্যাহত ইচ্ছে আমার আমার আচ্ছন্দ ছবিছেঁড়া চোখ
গানরেণু
৩
গান থামে না। তবুও গানকে থামিয়ে দিতে হয়। গলার স্বর মোটা হয়ে গেলে, আড়ষ্ট হয়ে গেলে গুনগুন করাই শ্রেয়। কিন্তু কবিতাকে আমরা কোথায় থামাব? কবিতার নিজের কি কোনো পথ আছে! এত বেড়া দিয়ে হইহুল্লোড় করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন যাঁরা, মাঝরাতে আমি কি তাঁদের ডেকে শোনাব এই কবিতা? চোখ নিভে যায় চোখের আড়ালে। জল দিয়ে কবিতার জোছনা বোনা ছাড়া কীই বা করার থাকে? তাই তো বোধহয় এই কবিকে এত দেরিতে পাঠ করতে এসে অপরাধবোধ কাজ করে। ‘প্রলয়পয়োধি’, ‘বাগর্থবৈভব’, ‘শ্যাওলানিথর’, ‘বায়সপ্রবর’, ‘শতশব্দক্রতু’, ‘ভাষাপারাবার’, ‘আনাভিপিচ্ছিল’, ‘মুখমদ’, ‘বননিশিপুর’, ‘পাখিচরণ’, ‘স্বপ্নবেণীসংহার’, ‘বিরহী ধূপ’ এমন অজস্র শব্দ তাঁর বাগান থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। মনে হয় কখনো আমিও কোনো সুন্দর মালা গেঁথে তাঁকে জানাতে পারব আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ সমূহ:
১। শিলা কিংবা শৈলী বিষয়ক
২। পাঠ ও পতনের কবিতা
৩। অপড়া অবাক্ প্রতিমারা
৪। নির্বাচিত সমর চক্রবর্তী
বিশেষ কৃতজ্ঞতা:
কবি সুবীর সরকার