Hello Testing

4th Year | 2nd Issue

৩১শে বৈশাখ, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 15th May, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

উ জ্জ্ব ল পা ঠ ।  পর্ব ৬

সে লি ম   ম ণ্ড ল

নিজের দরজার সামনে: নিশীথ ভড়

 

‘কবিতা সংগ্রহ’ হল একজন কবির যাবতীয় লেখার সংগ্রহ। বছর তিনেক আগে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে খয়ের রঙের কভারের ‘কবিতা সংগ্রহ’ নামে একটি বই চোখে পড়ে। এত রুগ্ন ‘কবিতা সংগ্রহ’ কীভাবে হয়? বইটি হাতে তুলে নিয়ে কয়েকটি কবিতা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়েই পড়ি। সহজ সরল ভাষায় লেখা কী অদ্ভুত সব লেখা! সহজের একটা সৌন্দর্য আছে। আলাদা রূপ-রস আসে। আমরা সহজে অনুধাবন করতে পারি বলে অনেকসময় এড়িয়ে যাই। এই এড়িয়ে যাওয়া একটা বদভ্যাস। এই বদভ্যাস আসলে একজন তৃষ্ণার্ত পথিকের কাছে কাছের কোনো কলতলা পেরিয়ে দূরের কোনো কলতলার খোঁজ। কবির নাম নিশীথ ভড়।সত্তর দশকের এই কবি জীবনপথে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়েছেন। তিনি চেয়েছিলেন একটু প্রশান্তি। সে কবিতা হোক, বন্ধুবান্ধব বা সংসার। কিন্তু তিনি যে প্রশান্তি চেয়েছিলেন সেই প্রশান্তি পাননি। পুড়িয়েছিলেন নিজের অসম্পূর্ণ দুটি উপন্যাস, আটটি ছোটোগল্প এবং দুশো সত্তরের বেশি কবিতার পাণ্ডুলিপি।যৌনপল্লীর পরিমণ্ডপে বাস করেছেন। স্বচক্ষে দেখা এক নির্যাতিত, বর্ণাঢ্য জীবনের নির্যাস তাঁর কবিতায় প্রতিফলিত হয়েছে নানাভাবে।

 

 

কবির জীবদ্দশায় মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায়। নিজের পায়ের শব্দ (১৯৮৪), খেলার তুচ্ছ প্রতিমা (১৯৮৬) ও তীর্থ সংহার (১৯৮৮)। তিনটি কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে বোঝা যায়— কবির অন্তর্দৃষ্টি কত তীক্ষ্ণ। কতটা জীবনকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে চলে গেছে বহুদূর। তিনি কি সত্যিই চেয়েছিলেন সাজাতে? তাঁর কবিতার শরীরে জীবনের অসংখ্য ছিদ্র ফুটে থাকে। আর তাতে ফুটে থাকে অসংখ্য চোখ। সেই চোখ কার?সেই চোখ দিয়েই কি টপটপ করে জল ঝরে?কবি ‘জল নেই’ কবিতায় একধরনের জলহীন জলের চাহিদার কথা বলেছেন। কোন জল সেটা?

পড়া যাক কবিতাটি—

 

জল নেই

 

জল নেই, জলের চাহিদা নেই কোনো

জল না পেলেও দিন কেটে যাবে, এরকমভাবে

এর আগে ভাবিনি কখনো

 

এই জলহীন দেশ আমার স্বপ্নের পাশে শুয়ে

আমার স্বপ্নেরও কোনো জলের পিপাসা নেই আর।

 

সুখে আছি, সকলেই সুখে

 

জল নেই, জলের চাহিদা নেই কোনো

 

এই কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার মধ্যে বারবার অভিঘাত ঘটেছে। আমি শুনতে পেয়েছি সেই শব্দ যা আমার মধ্যে সারাক্ষণ বেজে উঠেছে। জলের শব্দ কী যে মারাত্মক হতে পারে তা শুধু অনুভব করা যায়। আমরা জলে ডুবতে পারি। জলে ভেসে যেতে পারি। তবে জলের শব্দেও হতে পারি চুরমার। আমাদের এই চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়া শরীর কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য আমরা ছাড়া কেউ নেই। সেই গভীর আর্তিই যেন কবিতার অন্তরে বেজে উঠেছে। কবিতা সম্পর্কিত বিনয় মজুমদারের একটি কথা মনে পড়ে যায়— “কবিতা হচ্ছে চিরস্মরণীয় বাক্য সমষ্টি যা হুবহু মুখস্থ করা যায়”। কবি নিশীথ ভড়ের এই কবিতাটিও যেন সেইরূপ। মনের ভিতর কোথাও যেন গেঁথে যায়। আলাদা করে আর মুখস্থ করতে হয় না।

প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘নিজের পায়ের শব্দ’ থেকে পড়া যাক আরও কিছু কবিতা:

 

বাসনা মিটল না

 

কোথায় জ্বালা জুড়োই আমার ঘরের খুঁদকুড়োই ভর্তি আরশোলা নাদিতে

চক্ষে করমচা ফুটেছে ভাগ্য এখন যা নিভন্ত নিষিদ্ধ পল্লীতে

একটা বেশ্যা ঊরু তুলল, শরীরেও কি রোঁয়া উঠল আর কিছু জানি না

হরি-হরি বলতে বলতে বৈতরণী কি পেরুতে পারানি লাগবে না

মন্দ যদি বেশ করেছি, হৃদয়-কপাল ভেঙে দিয়েছি, ভাঙাই চেয়েছিলে

কেন এমন হলো আমার জন্মে কী দোষ ছিল শুধু ধূসর বা পাটকিলে

জামায় কেন আমায় মানায় তুচ্ছ সাড়ম্বরে বানায় চোখে পৃথিবী ঘুরছে না

পা রয়েছে স্থির, কামে পাগলামি গভীর, তবু বাসনা মিটল না

 

মানায় না

 

কার সঙ্গে কথা বলবে, বলবে না

কার সঙ্গে চলবে এবং চলবে না

কাদের কথা শুনবে, কাদের শুনবে না

ভাবতে-ভাবতে দেখলে তোমায় মানায় না

 

মানায় না এ মিথ্যে করতলের ওপর আমলকী ফল

মানায়  না এ মিথ্যে ঠোঁটে স্তবের গন্ধ দিব্যসজল

মানাচ্ছে না কলাবেচার সঙ্গে রথটি দেখার এ ছল

 

ভাবতে-ভাবতে-ভাবতে হাতের দস্তানা

খুলে রাখতে গিয়ে দেখলে মানায় না

বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে যে হায়না

তাকে খোঁচা দেওয়া তোমার মানায় না

বাঁচার গোপন হদিশকাঠি যে পায় না

তাঁর দু চোখে অশ্রুও ঠিক মানায় না

 

মেথর

 

যে মেথর সকালবেলা আমাদের নর্দমা পরিষ্কার করে

আর বিকেলবেলা ট্রানজিষ্টর হাতে বেড়াতে যায়

রাতের বেলা বৌকে বলে

‘তোকে কিনে দেব একটা শাড়ি

পরেছিল হেমামালিনী

তুই কতদিন আসিসনি

আমার পাশে

বল’

তারা তিনজন্ না একজন ভাবতে-ভাবতে দেখি

এক সকালে সে এসে বলছে

‘তিনদিনের ছুটি দিতে হবে বাবু

দেশে যাব, বিয়ে করতে’

‘কেন রে?’     

‘ও-সে ভেগে গিয়েছে তিনমাস হঠাৎ’

 

হুম, পরের বাড়ির এঁটোকাটা সাফ করতে নিজের ঘরে নিদেনপক্ষে

বৌ তো একটা চাই-ই।  

 

কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থেই বোঝা যায়— কতটা মননশীল ছিলেন লেখার ব্যাপারে। নিশীথ ভড়ের অন্তরঙ্গ বন্ধু কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল বইটির ভূমিকাতে লিখেছেন, “স্কুলে থাকাকালীনই নিশীথের লেখা (সাবালক পাঠকের জন্য নাবালক পত্রিকায় লেখা) পত্রিকায় ছাপা হয় । সেটা ৬৬-র শেষদিক। সম্পাদক ছিলেন গৌরাঙ্গ ভৌমিক।” ভাবা যায়? একজন কবি যিনি ৬৬-তে সাবলীল লিখিছেন আর প্রথম বই প্রকাশ করছেন ১৯৮৪ সালে!

 

নিশীথের কবিতায় শ্লেষ খুব তীব্রভাবে থাকে। জীবনকে গভীরভাবে খনন করলেই বোধহয় এভাবে বলা যায়! ‘মানায় না’ । সত্যিই কি আমরা জানি, আমাদের কোথায় মানায়?কীভাবে মানায়? দ্বন্দ্ব আর অন্তর্দ্বন্দের মাঝখানে আমরা নিজেরাই রাস্তার মাঝে ছড়িয়ে যাওয়া শস্যবীজ। যেকোনো মুহূর্তে হড়কে পড়তে পারি। মানায় না চোখে জল… মানায় না বুকের মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা হায়নাকে খোঁচা দেওয়া… মানায় না ভাবতে কেন মানাচ্ছে না… কবিতাটি যত পড়ি ভাবি— “মন্দ যদি বেশ করেছি, হৃদয়-কপাল ভেঙে দিয়েছি, ভাঙাই চেয়েছিলে/ কেন এমন হলো আমার জন্মে কী দোষ ছিল শুধু ধূসর বা পাটকিলে”।

 

 ‘মেথর’ কবিতার একটি লাইনই যথেষ্ট আমাদের ফালা ফালা করে দেওয়ার জন্য।“হুম, পরের বাড়ির এঁটোকাটা সাফ করতে নিজের ঘরে নিদেনপক্ষে/ বৌ তো একটা চাই-ই।”কী নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছেন এই লাইন! সত্যিই তো যে লোকটা সকালবেলা আমাদের নর্দমা পরিষ্কার করে আর বিকালবেলা ট্রানজিষ্টর হাতে ঘুরে বেড়ায় তার বউ কি হতে পারে না বেনারসি পরে হেমামালিনী?নাকি নিম্নবৃত্তের মানুষদের একটাই কামনা হবে— পরের বাড়ির এঁটোকাটা সাফ করার জন্য একটা বউ?

 

কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘খেলার তুচ্ছ প্রতিমা’। এই কাব্যগ্রন্থে কবি আরেক নিশীথ। যিনি একটি ভোরের অপেক্ষা করছেন। যে ভোর নিয়ে যাবে তাঁর শূন্যতার সব অন্ধকার। শবের মতো পড়ে থেকে শুনতে চান না লক্ষ লক্ষ শিশুর কান্না। সব ফুলের মতো সহজ হোক। পৃথিবীর শুশ্রূষার দিন ভরে উঠুক বাড়ির দরজায় দরজায়। চোখের তারায় কাঁপতে থাকা ভয় নিয়ে কবি দেখতে চান না— বাবার অসুখে মা যাক মন্দিরে… ফুলেরা নত হয়ে অরোগ্যের অনুমতি দিক আর অল্পবয়সির মতো মা পরে নিক পায়ে লাল টকটকে আলতা…

 

পড়া যাক এই কাব্যগ্রন্থ থেকে তিনটি কবিতা–

 

ভোর

 

নিবিড়ভাবে মন্থন করুক আমাকে আজকের ভোর

আমার সমস্ত ভোর ভরে যাক মৃত্যুর হাসিতে

                           জন্মের প্রথম কান্নায়

এত শুচি পৃথিবীকে আমি ভালোবাসি

প্রত্যেকের কপালে রয়ে গেছে চন্দনতিলক

প্রত্যেকের ঘরের ভিতর লক্ষ লক্ষ শিশুর কলরব

                                    জেগে উঠবে এখনি

শুকতারার ম্লান মিলিয়ে যাবার আগে

                                আমার স্তর থেকে স্তরান্তরের শূন্যতায়

 

 

ফুলের মতো সহজ

 

আমার বাবার অসুখ করলে মা যান মন্দিরে

তাঁর চোখের তারায়-তারায় কাঁপতে থাকা ভয়

সর্বাঙ্গে মেখে স্নান করেন পুরোহিত, আর সুদূর দেবতা

ধূপধুনোর ধোঁয়ায় নাচতে নাচতে নাচতে নাচতে নাচতে

ভেঙে পড়েন শব্দে, ঘণ্টার শব্দে

বাগানের সব ফুল নত হয়ে আরোগ্যর অনুমতি দেয়, আর

মা অল্পবয়সীর মতো রাঙা হয়ে বাড়িতে এসে আলতা পরেন

                                                   অনেকদিন পর।

 

ঋণ

 

তোমার শরীরের আলো এসে পড়ুক আমার চোখের ওপর

                                        আমার অন্তরাত্মায়

আর অল্পে-অল্পে জেগে উঠুক ছোটোবেলার সকাল

সূর্য ওঠার আগে শুকতারার শুচিতার কাছে ঋণ

ওগো মেয়ে, তোমার দু হাতের অঞ্জলিতে

                     মনে পড়ল নীলিমাময় শান্তিপ্রতিমা

আর আমার আনন্দ চতুর্দিকের হাওয়ায় হাওয়ায়

                       বানিয়ে তুলছে নিবেদনের গান  

 

যত দিন গেছে, কবির মধ্যে যেন জেগে উঠেছে মহাজাগতিক চেতনা। কবির ভিতর আশ্রয় নিয়েছে এক ধ্যানী পুরুষ। প্রেমিক পুরুষ। তিনি যেন চাঁদের রেণুতে মিশে ফাঁকি দিতে চান জীবনের ভয়াবহ পরিহাস। কখনো চান নিজের বিরুদ্ধে যেন বিদ্রোহ ঘোষণা করতে। সেই বিদ্রোহই যেন নীলিমাময় শান্তিপ্রতিমা। এটুকুই যেন কবির নিজের কাছে ঋণ…হাওয়ার শরীরে তিনিই যেন হয়ে উঠবেন কোনো সরল কণ্ঠের গান। করুণাহীন গ্রীবায় আঁকবেন নতুন ভাস্কর্য। আকাশে জ্বর ও প্রলাপ তুলে নিজ রক্তে দুলে উঠবেন অন্যমনস্কতায়।

 

শীর্ষসংকটে

তখন যাত্রীরা ক্লান্ত, নর্তকী রূপসী যারা শেষ করতালি দিয়ে

বসে আছে নতমুখ, বিশ্রামের প্রয়োজনে। যারা কবি

চাঁদের রেণুতে মিশে ফাঁকি দিতে চেয়েছিল

                                    জীবনের ভয়াবহ ফাঁস

তাদের মুখের স্পর্শে প্রথম আলোর গান, প্রভাতের অরূপ ভৈরবী।

এখন বিচার হবে প্রেমিকের ।

এখন বিচার হবে সেই প্রতিবাদী মানুষের।

      প্রেমিক এলেন। তাঁর মুখ দক্ষিণী ভাস্কর্য যেন, ক্ষমাহীন, নিষ্ঠুরতাহীন

সকালে মৃদুস্তবে তাঁর উত্তরীয়ে যেন কিছুটা চাতুর্যে মিশে আছে

যাত্রীদল সমভাবে তরুণের সাথে একস্বর, ঘোষণা করল

এবার বিচার হবে প্রেমিকের

সেই প্রতিবাদী মানুষের।

প্রেমিক রহস্যে লীন মূর্তিতুল্য, চোখে তাঁর অসামান্য জ্যোতি।

 

মুখরেখা

 

কে ভাঙাবে ঘুমঘোর?কে জাগাবে সরল কণ্ঠের গান?

পবিত্র কুসুমগুলি একে একে স্বপ্ন হয়ে ঝরে গেল…

সারারাত শুধু হাওয়া অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী বালকের মতো আসে যায়

খুব একা, গভীর চুলের নীলে, ভিজে ঘাম পিঠময়

সারারাত অতন্দ্র প্রহরী যেন দ্বার খুলে মৃত শরীরের মতো

পরিত্যক্ত                   রেখেছে আমায়

কে আর আকাশে আজ জ্বর ও প্রলাপ তুলে

আমার রক্তেই যেন দোল দেবে অন্যমনস্কতা

কে আর করুণাহীন গ্রীবার ভাস্কর্য দেবে

                             করুণার মতো, প্রিয়মদ…

   কে যেন নিষ্ঠুর হাতে লুণ্ঠন করে যায় আমার শরীর সারারাত

মানুষের মতো মুখ, অন্তরালে— অবিশ্বাস— আরেক মানুষ।

 

কবি রণজিৎ দাশের এই কথাটির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত না হয়ে পারা যায় না— “নিশীথের কবিতার একটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এই যে, তার অনেক কবিতাই পড়ামাত্র আমাদের মনে পড়বে সেসব কবিতার বিভিন্ন পূর্বসূরি কবিদের ছায়াপাতের কথা, অথচ একই সঙ্গে আমরা নির্দ্বিধায় মেনে নেব যে সেই কবিতাগুলি নিশীথের বলিষ্ঠ স্বকীয়তার গুণে একই সঙ্গে যৌগিক ও মৌলিক”।

 

কবি মারা যান ২০১২ সালে। কিন্তু শেষ কাব্যগ্রন্থ ‘তীর্থ সংহার’ প্রকাশ হয় ১৯৮৮ সালে। মৃত্যুর আগে ২৪ বছর তাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ হয়নি। বলা যায়— একপ্রকার নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছিলেন। কবির এই বন্ধুর কথায় “নিশীথদা জীবন্মৃত ছিলেন। বেঁচে গেছেন।”

 

 

পৃথ্বী বসুর একটি লেখা থেকে তাঁর ডায়েরির কিছু টুকরো অংশ তুলে দেও্য়া হল। এই অংশটি পড়েব্যক্তি নিশীথ ভড়কেও কিছুটা জানতে পারি।

 

“১. ‘…আত্মজিজ্ঞাসার অধিকার থেকে যেমন যেকোনো বিদ্যা ও ধর্মের আবির্ভাব, কবিতারও জন্মসূত্র তাই। আত্মজিজ্ঞাসাই আমাদের ভবিষ্যত কর্মপ্রবর্তনার দিকে নিয়ে যায়।… কল্পনা আর বাস্তব, বই আর বর্তমান, প্রত্যক্ষ আর অপ্রত্যক্ষ এ-সমস্তই আমাদের জানা-অজানার মধ্যে, নিরন্তর ফারাক আর মিলনের মধ্যে কবিকে গড়তে থাকে ক্রমশ। তাই আর সব মানুষের মতো কবিরও জানা নেই সে কী হয়ে উঠবে।…’”

 

২. ‘… কাল একটা কবিসম্মেলন হল। হাততালি পেলাম প্রচুর। লক্ষ করে দেখেছি আমার যে সমস্ত superficial reality নিয়ে লেখা, সেগুলোই ভালো লাগে লোকের। অথচ আমি ওরম লেখা লিখতে চাই না। চাই গভীর, মর্মজ্ঞ, মায়াবী কিছু লিখতে, যা সভায় পড়া যায় না, বিরলে বসে, নিঃশব্দে পড়তে হয়।…’

 

৩. ‘… দুঃখ, আমার আনন্দকে, আমি দু-হাতে নিবিড়ভাবে পাব। সব মানুষের আত্মা নেই। অথচ আত্মা দিয়ে আত্মাকে দেখাই ঠিক দেখা। সেই আত্মাই লাভ করতে হবে আমাকে। আমার জীবন সত্যে প্রবেশ করুক, সত্যময় হয়ে উঠুক, এই একটামাত্র প্রার্থনাই ধ্বনিত হোক আমার নিঃশব্দে।…’

 

নিবিড়, আত্মমগ্ন এই মানুষটি বার বার চেয়েছেন একলা হতে। সমস্ত ভিড়, আলো থেকে সরিয়ে রেখেছিলেন। অজস্র লেখা নষ্ট করেছেন, যা আর পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তিনটি কাব্যগ্রন্থ আর অপ্রকাশিত কিছু কবিতা নিয়ে সত্তর দশকের এই কবির কবিতা সংগ্রহ প্রকাশ পায়। কবি রণজিৎ দাশের সুসম্পাদনা ও কাছের বন্ধু কবি পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের স্মৃতিতাড়িত অসামান্য একটি ভূমিকা এই সংকলনের আভা ছড়িয়েছে। আমরা যাঁরা পাঠক, যতদূর চোখ যাবে তার থেকেও বেশি তাকাব বলে ওই আভা ধরেই হেঁটে বেরিয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে যেন ফিরে এসেছি নিজের কাছে। কবিতার পথ যতই বিস্তৃত হোক না কেন, আলটিমেটলি তা গোলাকার। ঘুরতে ঘুরতে একসময় ঠিক নিজের গন্তব্যেই ফিরে আসতে হয়। ফিরে আসার পর দেখা যায়— কবিতার যে বীজটি আমরা সারা পথ ছড়িয়ে এসেছি, তার গাছছায়া আসলে আমাদের ঘরেই পড়েছে…

কবি নিশীথ ভড়

তথ্যসূত্র

কবিতা সংগ্রহ: রাবণ প্রকাশনা

Prohor.in

আরও পড়ুন...