উ জ্জ্ব ল পা ঠ । পর্ব ৮
১
‘উজ্জ্বল পাঠ’ সিরিজিটির বাকি সাতপর্বে যে সমস্ত কবিকে নিয়ে লিখেছি, তাঁদের কোনো না কোনো কাব্যগ্রন্থ আমি সংগ্রহ করে পড়েছি। চেষ্টা করেছি সমগ্র পড়তে। এই প্রথম এমন একজন কবিকে নিয়ে লিখছি যাঁর কোনো সম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ আমি পড়িনি। তবুও লিখছি, এজন্য কৃতজ্ঞ ‘স্বকাল’ পত্রিকার সম্পাদক প্রকাশ দাসের কাছে। আগস্ট ২০১৬ সংখ্যাটি তিনি করেছেন কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিককে (১৯৩০-২০০১) নিয়ে। তাঁকে নিয়ে বিভিন্ন গুণীজনদের লেখা তো রয়েছেই, তবে আমার যেটা আমার সবথেকে ভালো লেগেছে তা হল গৌরাঙ্গ ভৌমিক শতাধিক কবিতা তিনি সংখ্যাটিতে ছেপেছেন। আমি বারবার মনে করি, অন্যের চোখে না; একজন কবিকে নিজ পাঠে আবিষ্কার করা দরকার। এই আবিষ্কারের আলাদা আনন্দ থাকে।একজন আনালোচিত কবি, যাঁর কোনো কাব্যগ্রন্থ খুঁজে পাওয়া একপ্রকার দুষ্কর ব্যাপার-স্যাপার, সেক্ষেত্রে এই একশ কবিতা কী মূল্যবান বলে বোঝানো সম্ভব না!
কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিক ‘যুগান্তর সাময়িকী’বিভাগে চাকরি করতেন। সম্পাদনা করতেন ‘অনুভব’ লিটল ম্যাগাজিন। আড্ডা দিতে ভালোবাসতেন। তবে কোথাও অনর্থক বেশি সময় কাটাতেন না। আসর ছেড়ে উঠে চলে যেতেন। একজায়গায় বেশিক্ষণ বসলে তাঁর মনে হত, পৃথিবীর সমস্ত আয়োজন যেন ফুরিয়ে গেছে। শব্দের মধ্যে যে জীবন তার অনুসন্ধান প্রয়োজন। কিন্নর রায় তাঁর একটি লেখায় বলেছেন, “গৌরাঙ্গ ভৌমিক মানেই নিবিড় আড্ডা। ঘন ঘন চা। তার সঙ্গে অনুপান হিসেবে সিগারেট। ক্রমাগত ধূমপানের ফলে তাঁর ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমার ফাঁকে তীব্র নিকোটিন হলুদ। প্রায় বারোমাসই খাদি বা হ্যান্ডলুমের রঙিন পাঞ্জাবি, সেইসঙ্গে মিলের ধুতি। ক্কচিৎ কখনও ঢোলা পায়ের দড়ি ভরা পায়জামা। শীতের দিনে পাঞ্জাবির উপর খদ্দরের জহরকোট, আর একটু বেশি শীতে রঙিন শাল, চাদর, পায়ে স্যান্ডেল।”
২
প্রথমে পড়া যাক, কবি গৌরাঙ্গ ভৌমিকের কয়েকটি কবিতা—
এখনো মানুষ
মানুষ এখনো কাঁদে, কান্না আজও ভালো লাগে বলে
বাসা বাঁধে, ভালোবাসে, কিংবা দুঃখে
আবছা করে ঘর।
কখনো বিস্মৃতি আসে, কখনো-বা প্রতিশ্রুতি
অবিশ্বাস্য তারা হয়ে জ্বলে—
আকাশ উন্মুক্ত হয় অসুখের পর।
আবেদন
শুনেছি, টাকার মূল্যে সবই কেনা যায়—
দোতলার মস্ত সিঁড়ি,
দক্ষিণের খোলা বারান্দায়
অসামান্য জলের প্রপাত।
বাড়ে রাত। সকলের কাছে আমি ঋণী।
নেই কোনো অর্থের সঞ্চয়।
কি দিয়ে এসব আমি কিনি?
ধার পাব তোমার হৃদয়?
চাঁদ নিয়ে
যেদিন পুকুরে চাঁদ খান্খান্ ভেঙে গিয়েছিল,
সেদিন ভীষণ দুঃখ পেয়েছিলে তুমি,
পুকুর ছিল না স্থির সেইদিন মধ্যরাত্রিবেলা।
আজকেও আশ্চর্য চাঁদ শালের জঙ্গল ঘেঁষে হেঁটে আসছে
শাদা এক ভালুকের মতো
তাকে নিয়ে খেলা যায় ‘চাঁদ চাঁদ’ খেলা?
ইঁদুর
পাহাড়ী অরণ্যে আমি বেশ আছি— এই ভেবে
গিরিখাতে যখন নেমেছি,
আমার নরম স্বপ্ন কিছুটা ব্যাহত হল ধূসর রঙের এক ইঁদুরের ডাকে—
‘দেখ হে গোপন পথে হাঁটাহাঁটিব মোটে ভালো নয়,
দেখ আমি কী রকম আটকা পড়ে গেছি।’
সতর্ক হওয়ার দায় স্বপ্নের ভেতরে কারো নয়,
স্বপ্নভঙ্গে ইঁদুরের কথাগুলি পুনরায় ভেবে দেখা যাবে—
এমন সান্ত্বনা নিয়ে গুহামুখে বিমলার সাক্ষাৎ পেয়েছি।
বিমলা চতুরা মেয়ে নয়, ভালোবেসে কাঁদতে পারে দুঃখের সময়।
সেও জানে, দুঃখহীন ভালোবাসা একান্ত দুর্লভ।
তার তৈরি ফাঁদে এক আজ রাতে ইঁদুর পড়েছে।
উপরের তিনটি কবিতা পড়তে গিয়ে কী মনে হয়?জীবানানন্দ পরবর্তীরা কবিরা যখন অনেক স্মার্ট, নির্মাণে আত্মসচেতন তখন কেন তিনি কবিতার প্রাচীন সুর নিয়ে থেমে আছেন?কবিতায় ডিজে বাজিয়ে যে হ্যাঙ্গামা তা থেকে কেন তিনি নিজেকে দূরে সরিয়ে রেখেছেন? এই উত্তর পাওয়ার জন্য একজন কবিকে ধারাবাহিকভাবে পড়া প্রয়োজন। এই ধারাবাহিকতা আসলে খান্খান্ করা চাঁদের মতো। পুকুরজলে পড়ে থাকা এই চাঁদ আমরা অপার দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে বলতে পারি— আকাশ উন্মুক্ত হয় অসুখের পর। এই অসুখ কী? নিষ্প্রভ হয়ে যাওয়া শরীরবেদনা? নাহ্ এই অসুখ আসলে আত্মকেন্দ্রিকতা। আত্মকেন্দ্রিকতার নিজস্ব কোনো রোডম্যাপ থাকে না। হাঁটতে হাঁটতে যখন ক্লান্ত লাগে তখনই সন্ধ্যা নামে। কোনো কোনো সন্ধ্যা তাঁর রাত্রির মতো। তিনি হিসেব করতে বসেন জীবনের লেনদেন। হয়ে ওঠেন এক প্রেমিক পুরুষ। তাঁর নরম স্বপ্নে শুনতে চান খয়েরি ইঁদুরের ডাক। খোঁজ করতে থাকেন বিমলা নামের মেয়েটিকে, যে ভালোবেসে দুঃখের সময় কাঁদতে পারে। কারণ, দুঃখহীন ভালোবাসা একান্ত দুর্লভ।
একজন কবি প্রকৃতির মধ্যে আত্মস্থ হয়ে উঠলেই বোধহয় তিনি ধ্যানী হয়ে ওঠেন। গৌরাঙ্গ ভৌমিক তেমনই এক ধ্যানী পুরুষ। তিনি চান না, জ্যোৎস্না নিভিয়ে কেউ হ্যারিকেন জ্বালিয়ে রাখুক। প্রকৃতি তার নিজের মতো সুন্দর। আমরা তাকে রঞ্জিত করতে গিয়ে হত্যা করি। ‘পাখিরাও শিখে ফেলল’ কবিতায় তাঁর আর্তি মনে করায় ‘বন্যরা বনে সুন্দর, শিশুরা মার্তৃক্রোড়ে’। শিকারীর দল যদি পাখি শিকার করে তাঁদের ভাষা শিখিয়ে দেন, তাহলে সত্যিই তো আমরা অরণ্যভ্রমণে কী সুখ পাব?
পাখিরাও শিখে ফেলল
প্রকৃত স্বাধীন ছিল ঐসব পাখিগুলি, আশ্চর্য শুভ্রতা ছিল
তাদের পালক।
শিকারীরা ধরে এনে তাদের শেখাল শুধু নষ্ট সব মানুষের ভাষা।
অরণ্য-ভ্রমণে সুখ আমরা তবে পাব কার ডাকে?
সাধু ক্রিয়াপদেলেখা গদ্যকবিতা খুব একটা লক্ষ্য করা যায় না। পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলালের কবিতার ক্ষেত্রে এই প্রয়োগ দেখেছি। তবে গৌরাঙ্গ ভৌমিক অনেক আগেই কবিতায় এই সাধু ক্রিয়াপদের ব্যাবহার করেছেন। যখন বাংলা কবিতা এই পুরোনো ঘরানা ত্যাগ করতে চাইছে, তখন তিনি কেন এই সুরে লিখতে চাইছেন? কবিতা বা ভাষা অনেকসময় মুক্তি খোঁজে। একটানা দীর্ঘক্ষণ যেমন একই সুরের গান শুনতে ভালো লাগে না। তেমনটা কবিতার ক্ষেত্রেও।
বাড়িটা
বাড়িটার বাহিরে দেখিয়াছি, ভিতরে দেখি নাই।
দেখিলাম। ঘরে ঘরে আলো জ্বলিতেছে, পাখা ঘুরিতেছে,
রেডিও চলিতেছে, সানাই বাজিতেছে, সেতার বাজিতেছে
টি-ভির পর্দা কাঁপিয়া কাঁপিয়া উঠিতেছে, বাড়িতে কেহ নাই।
দারোয়ানকে কহিলাম, কী ব্যাপার! কেউ নাই, অথচ…
দারোয়ান কহিল, নাই বলিয়াই তো এত উদ্যোগ আয়োজন,
জাগাইয়া রাখিবার এত চেষ্টা। বাড়ি ঘুমাইয়া পড়িলে
যাহারা বাহির হইয়াছে, তাহারা ফিরিবে কী করিয়া?
একদিন না একদিন সকলকে ফিরিতে হইবে।
পড়া যাক, আরও কয়েকটি কবিতা—
অথচ দুঃস্বপ্নে
হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখি, মাথার ওপরে গাছ, বৃদ্ধ পিতামহ যেন,
ছায়া দিচ্ছে কুণ্ঠাহীণ, প্রতিবাদহীন।
অথচ দুঃস্বপ্নে আমি পৃথিবীর সব গাছ মৃত দেখে
ভীষণ কেঁদেছি।
দুঃখের ভেতরে দুঃখ
নিভন্ত আগুন জ্বলে যে-রকম বহুক্ষণ ধরে, সেরকম প্রতিদিন সূর্যোদয় হয়
দুঃখের ভেতরে দুঃখ জমা রেখে মানুষেরা জেগে ওঠে,
মানুষের সঙ্গে কথা বলে।
আমাকে মৌনতা ভেঙে এসব শোনাতে হবে? এ রকম ভয়
জেগে থাকে প্রতিক্ষণ অলৌকিক বৃক্ষের আড়ালে।
ধ্বংসের বিরুদ্ধে
আমার মৃত্যুর পরেও রাস্তায় রাস্তায় আলো জ্বলবে,
কলে জল আসবে, নতুন রাস্তা তৈরি হবে,
বাড়িঘরে রং লাগানো হবে।
আমার মৃত্যুর পরেও গাছে গাছে ফুল ফুটবে,
আকাশে পাখি উড়বে, বৃক্ষরোপণের উৎসব হবে,
দোলনা পার্কে ছুটোছুটি করবে ছেলেমেয়েরা।
আমার মৃত্যুর পরেও কুলুমানালি বেড়াতে যাবে মানুষ,
মাথার ওপরে বিমান উড়বে, জাহাজের ভোঁ শোনা যাবে,
দূরের দিকে ছুটে যাবে রাতের ট্রেন।
বলতে বলতে কী যেন সুখের আবেশে তিনি চোখ বুজলেন।
আমি বললুম, ‘ব্যস, এতেই আপনি নিশ্চিন্ত?’
তিনি বললেন, ‘হু, এতদিন আমি মিছিমিছিই ভেবে যাচ্ছিলুম, যে,
আমি মরলে আমার ছেলেমেয়েদের কী হবে? কোন্ অন্ধকারে
আমি রেখে যাব তাদের? এখন বুঝতে পারছি,
আমার মৃত্যুর পরেও ধ্বংসের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে মানুষ’।
কবি স্বপ্নের ভিতর দুঃস্বপ্ন দেখেন— তাঁর মাথার উপর থেকে যেন ছায়া সরে গেছে। কোথাও যেন আর গাছ নেই। নিজেরভয় তিনি লুকিয়ে রাখছেন অলৌকিক বৃক্ষের আড়ালে। এই ভয়, এই লুকিয়ে থাকা, এই আড়াল কবিকে পারেনি ঘোর সংসারী থেকে বিবাগী করে তুলতে। তিনি বার বার চেয়েছেন অরণ্যের পথ ধরে কোনো বনদেবতার কাছে শান্তি পেতে। ‘আমি মরে গেলে আমার ছেয়েমেয়েদের কী হবে?’ এই লাইন থেকে বোঝা যায়— কবিতার শীত যতই হাড়ে লাগুক না কেন, রক্তমাংসে শৈত্যপ্রবাহ হবেই…নিজের ভিতরে দুঃখ জমা রেখে অপেক্ষা করতে হবে সূর্যোদয়ের। প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের একটি বিখ্যাত লাইন মনে পড়ে— “দুঃখ বড়ো হলে/ তাকে নিয়ে ঘর করা যায়”। সত্যি কি আমরা দুঃখ বড়ো হলে তার সঙ্গে ঘর করতে পারি? ঘর কি কেবলই আশ্রয়? ঘরের মধ্যেই আমরা জীবনের এত সুতো আমরা ছড়িয়ে ফেলি, পায়ে পায়ে জড়িয়ে যায়… আমরা বুনন শিখতে চাই। বহনেই আমাদের কেটে যায় বেলা। ধ্বংসের বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করার মতো মাথার অনুসন্ধান করতে করতে যে পথ আমরা খুঁড়ছি, তার মাটি নখে লেগে থাকি… নখ দিয়েই যেন বানিয়ে ফেলি বাড়ি…
৩
পাঁচের দশকের এই কবি কেন অপঠিত? কেন নতুন পাঠক প্রজন্মের পাঠকের কাছে তিনি ম্লান হয়ে রইলেন, তা জানা নেই। তবে কি তাঁর কবিতা সতেজ, স্বপ্রাণ কবিতা পারেনি নতুন পাঠক বা অনুজ কবিদের অন্তরে জায়গা করে নিতে? গৌতম বসুর হয়ত ঠিকই বলেছেন—“পরের লেখা ভালবাসতে না পারলে সে-অপ্রেম একদিন অনিবার্যভাবে আমাদের লেখাও গ্রাস করবে। খোলা আকাশের নীচে এমনই এক সুদীর্ঘ, হয়তো অনিঃশেষ, জলঝড়ের রাত কাটাবার জন্য আমরা নিজেদের প্রস্তুত রেখেছি তো?”
সবশেষে তাঁর কবিতাতেই বলা যায়—
“লোকটা দাঁড়িয়ে আছে এখানে একাকী।
হাত নেই, পা নেই, পায়ের তলায় নেই মাটি।
অথচ দাঁড়িয়ে আছে লুপ্ত কোনো সাম্রাজ্যের
সম্রাটের মতো।
তার শুধু আছে অহংকার।”