Hello Testing

4th Year | 3rd Issue | June-July

৩০শে আষাঢ়, ১৪৩০ বঙ্গাব্দ | 16th July, 2023

প্রচ্ছদ কাহিনী, ধারাবাহিক গদ্য, ছোটোগল্প, গুচ্ছ কবিতা, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, স্বাস্থ্য, ফ্যাশান ও আরও অনেক কিছু...

ভি ন দে শে । পর্ব ১০

ঈ শি তা  ভা দু ড়ী

হোয়াইট লেডি

বার্গেন হল ফিওরডের প্রবেশপথ। পশ্চিম নরওয়ের ফিওরড-ই যে স্ক্যান্ডিনিভিয়া-ভ্ৰমণার্থীদের সবচেয়ে বড়াে আকর্ষণ এ-কথা অনস্বীকার্য।
 
বার্গেন শহরের প্রাণকেন্দ্র হার্বার-অঞ্চল থেকে ফিওরড ট্যুর করা যায়, আমরা সেই ইচ্ছেতেই গুটিগুটি এগােলাম। কাউন্টারের মহিলা টিকিট দেওয়ার সময় আঙুল তুলে একটি লঞ্চ দেখিয়ে বললেন, চারটের সময় ছাড়বে। তখন ঘড়িতে তিনটে পনেরাে, পঁয়তাল্লিশ মিনিট হাতে সময়। আমরা বাজারে, রাস্তায় এলােমেলাে ঘুরে বেড়িয়ে পৌনে চারটের সময় এসে দরজার সামনে দু-চারটে মানুষের পেছনে লাইনে দাঁড়ালাম। এবং দাঁড়িয়েই রইলাম, ঘড়িতে এদিকে চারটে বেজে গেল। ব্যাপারটা কী! দরজা খােলার কোনাে চেষ্টাই নেই কেন! ইউরােপীয় মানুষেরা তাে খুবই সময়নিষ্ঠ, তবে এমন অঘটন কেন? অতঃপর প্রশ্ন করে জানতে পারলাম সেটি আদপে আমাদের লঞ্চ নয়। কী কাণ্ড! আমাদের লঞ্চ গেল কোথায় ? কাউন্টারের মহিলা তো হাত দিয়ে এই লঞ্চটিকেই দেখিয়েছিলেন! আমাদেরকে তখন সবাই দেখাল, ওই দেখ তােমাদের লঞ্চ ঘাট ছেড়ে চলে গেল। তাকিয়ে দেখি, দূরে একটি লঞ্চ যাচ্ছে, অনেক দূরে। হায় রে আমাদের এতগুলাে ক্রোনার পুরােটাই জলে গেল! ছুট ছুট ছুট, কাউন্টারে পৌঁছালাম।
 
কাউন্টারের মহিলা বললেন- ‘লঞ্চ তা তােমাদের ছেড়ে গেছে বাপু, টিকিটটা কালকের জন্য করে দিচ্ছি, তােমরা কাল যেও বরং।’
 
‘আরে না না কাল আমরা সকালের ট্রেনেই অসলাে ফিরে যাব, দেখ আমরা ইন্ডিয়া থেকে এসেছি, বার্গেন থেকে ফিরড় না দেখে ফিরে যাব?’
ভদ্রমহিলা তৎক্ষণাৎ কাউকে ফোন করলেন, তারপর কোনাে বাক্যব্যয় না করে অফিসঘর থেকে বার হয়ে আমাদের দুজনকে দুহাতে নিয়ে একটি বাতানুকুল ট্যাক্সিতে ওঠালেন। ট্যাক্সিতে কেন উঠব! বিপদের ওপর বিপদ! মহিলার কাছে এসে তাে আরও মুশকিলে পড়লাম। আমাদের অবস্থা না বুঝেই ট্যাক্সিতে উঠিয়ে দিচ্ছে, কতগুলাে নরউইজিয়ান ক্রোনার আরও খরচ হয়ে যাবে কে জানে! নাহয় ফিওরড় ট্যুরটা নাই করলাম! কিন্তু ভদ্রমহিলা আমাদেরকে কোনােই অবকাশ দিচ্ছেন না কিছু বলার। ট্যাক্সি-ড্রাইভারের সঙ্গে নিজস্ব ভাষায় অনেক অনেক কথা বলে ভদ্রমহিলার সময় হল আমাদের দিকে ফিরে তাকানাের, বললেন — “ড্রাইভার তােমাদেরকে একটি পয়েন্টে পৌঁছে দেবে, সেইখানে ‘হােয়াইট লেডি’ নামের লঞ্চ এসে তােমাদেরকে তুলে নেবে, তােমাদের কোনাে খরচ নেই, ‘হােয়াইট লেডি’ এই খরচ বহন করবে”। তখন জানতে পারলাম লঞ্চটির নাম ‘হোয়াইট লেডি’।
 
যাইহােক, ট্যাক্সি জোর কদমে বেশ অনেকক্ষণ ধরে চলল প্রায় তিরিশ মিনিট, জনমানবহীন রাস্তা দিয়ে। আমাদের কিন্তু বেশ ভয় হতে থাকল, এমন জনমানবইীন রাস্তায় দুজন তরুণীকে মেরে পাসপাের্ট, ডলার লুট হয়ে যাওয়া আমাদের দেশে এমন বিরাট কোনাে ব্যাপার নয়। কিন্তু তারা যতই রুক্ষ হােক, লােক কিন্তু সজ্জন। তাই ড্রাইভার বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদেরকে নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে দিয়ে চলে গেল।
 
এমন ফাঁকা জায়গায় আমরা দুটি মহিলাই শুধুমাত্র দাঁড়িয়ে, কখন লঞ্চ এসে আমাদেরকে তুলে নেবে এই অপেক্ষায়। লঞ্চ যদি না আসে তাে হয়ে গেল! ফিরব যে তার কোনাে ব্যবস্থাই নেই, কোনাে যানবাহনের চিহ্ন নেই, কোনাে ফোন বুথও আশেপাশে নেই, বুথ থাকলে কী হত তা অবশ্য জানি না।
 
আমরা শুধু শুধুই দুশ্চিন্তা করছিলাম, দু-চার মিনিটের মধ্যেই লঞ্চ এল, শুধুমাত্র আমাদের দুজনের জন্যই ওই ঘাটে লঞ্চ ভিড়ল এবং আমাদেরকে তুলে নিল। আমাদের ফিওরড় ভ্রমণ অবশ্য কিছুক্ষণ পর থেকে শুরু হল, কিন্তু পুরাে ঘটনাটি আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ভাবা যায়?
 
এই ঘটনার অনেকদিন পর, বারো কিংবা চোদ্দ বছর আগের একটি ঘটনার কথা না উল্লেখ করলে লেখাটি অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ট্যুরিজম ডিপার্টমেন্ট আয়ােজিত কলকাতার সাবেক পুজাগুলি দেখার জন্যে বাসে উঠবার আগে তাদের অফিসে বসে আছি, সেই সময় এক যুবক কাউন্টারে এলেন। কাউন্টারের মানুষ এবং সেই যুবকের কথােপকথনে বােঝা গেল, সেই যুবক ত্রিপুরা থেকে এসেছে, কলকাতা শহর দেখার নির্দিষ্ট ট্যুরটি নেওয়ার কথা ছিল তার, কিন্তু সে আসতে কিছু দেরি করেছে, বাস ছেড়ে চলে গেছে – হুবহু আমাদের পঁচিশ বছর আগের বার্গেনের হােয়াইট লেডি উপাখ্যান। কিন্তু পরবর্তী ছবি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। ত্রিপুরা-বাসী যুবক সকালে ত্রিপুরা ফিরে যাচ্ছে শুনেও কাউন্টারের ওপারের মানুষ কিছুই করতে পারল না, নিদেনপক্ষে টাকাটাও ফেরত দিতে পারল না। এহেন অবস্থায় বড়াে বেদনা, বড়াে আক্ষেপ, আমরা কেন তাদের মতাে হতে পারি না!

আরও পড়ুন...