ভি ন দে শে । পর্ব ২
সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।
আমরা যত্র তত্র এদেশ সেদেশ বেড়িয়ে বেড়াই, ভালই লাগে। লোকজন বলে, ‘একা একা বেড়াও, কোনো অসুবিধে হয় না?’ অসুবিধে আবার কি! দিব্যি তো বেড়াই! তবে স্বীকার না করে উপায় নেই, ক্রমশ স্মার্টনেসটা কমছে আমাদের। নানা রকম ওলট-পালট কাজ করে ফেলছি আমরা। যেমন বেজিং-এ গিয়ে প্রথমদিন সকালে ইয়ুথহস্টেল থেকে বেড়াতে বার হওয়ার সময় তাড়াহুড়োতে আমরা নিজেকে বেজিং-এ বেড়ানোর উপযুক্ত করে নিতে ভুলে গেলাম। অর্থাৎ কাছের বাস-স্টপটির নাম বা হস্টেলের ঠিকানাটি চৈনিক হরফে লিখিয়ে সঙ্গে নিতে ভুলে গেলাম।
সারাদিন মনের আনন্দে বেড়িয়ে বেড়িয়ে সন্ধে হয়ে গেল। এবার ডেরায় ফিরতে হবে, আমরা একটা বাসে উঠলাম, বাস-নম্বরটি হস্টেলের স্টপেজ থেকে বুদ্ধি করে দেখে নিয়েছিল সোমা। তখন তো আর জানি না শুধু নম্বর দেখে বাসে উঠে গন্তব্যে পৌঁছানো যায় না বেজিং-এ। সেখানে রাস্তাগুলো রিং রোড কন্সেপ্টে, একই রাস্তা দিয়ে আপ এবং ডাউনের বাস যায় না। অতএব সঠিক নম্বরের বাসে উঠেও আমরা গোল গোল হয়ে ঘুরতে থাকলাম। যদিও বাসে উঠেই কন্ডাক্টরকে আমরা জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম। কিন্তু সেই চৈনিক মহিলা কি বুঝে কি বলল আমাদের সেটা অবশ্য বুঝি নি আমরা। শেষমেষ আমাদের বারংবার প্রশ্নে আমাদেরকে কোনো একটি বিরাট চৌমাথায় নামিয়ে দিয়ে বাস উধাও।
সে রাস্তা কোন রাস্তা জানি না তখন আমরা, সেখান থেকে গন্তব্যস্থল কত দূরে তাও জানা নেই আমাদের। চোখ চেয়ে দেখি সিগারেট- কোল্ড ড্রিঙ্ক্সের একটি ছোট্ট দোকান আর বড় বড় দু-চারটে বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই চারপাশে। সেই ছোট্ট দোকানের দোকানী কিছুই বলতে পারলো না, রাস্তার লোকজন তো প্রশ্নটাই বুঝতে পারলো না। চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আমরাও কিংকর্তব্যবিমূঢ়। একে ওকে প্রশ্ন করে সদুত্তর না পেয়ে অত্যন্ত হতাশ সোমা আমাকে বলল ‘ব্যাপারটা কিন্তু খুবই সিরিয়স’। আমি কি বুঝছি না সেটা! আমিও তো বুঝছি। কিন্তু উপায় কি!
হঠাৎ সাইকেল নিয়ে এক তরুণ ও তরুণী হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে, মনে হল এরা কোনো সাহায্য করতে পারবে। ছুটে ছুটে তাদের গিয়ে ধরলাম। তারা কিন্তু যথার্থই চেষ্টা করল অনেক, ইয়ুথ হস্টেলে কথাও বলল নিজেদের মোবাইল থেকে। কিন্তু জানি না কেন তবুও কোনো সুরাহা হল না। নিজেদের ভাষায় তারা কি কথা বলল জানি না, কিন্তু তাদের চোখে-মুখে খুব সংশয়। ক্রমশ ভিড় জমে গেল। রাত সাড়ে আটটা বেজে গেল, প্রকান্ড চওড়া রাস্তায় গুটি কয়েক মানুষ এবং তারা আমাদেরকে ঘিরেই, অথচ আমাদের উদ্ধার হওয়ার কোনোই লক্ষণ দেখতে পাচ্ছি না। ক্রমশ ভিড় বাড়তে থাকছে। পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে তারা কোনো সুরাহা না করতে পারায় শেষমেষ তাদেরকে ধন্যবাদ দিয়ে তাদের থেকে বিদায় নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় দেখলাম না। ধন্যবাদ দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেলাম, তারা হয়তো একটু অবাকই হল। কিন্তু পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ‘ন যযৌ ন তস্থৌ’ অবস্থায় থেকে আমার হাঁফ ধরে গিয়েছিল। সোমা তো অনেকক্ষণ থেকেই বলছিল, এখানে দাঁড়িয়ে কিস্সু হবে না। আমিই নেহাৎ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম।
আস্তে আস্তে ভিড়ের মানুষ চলে গেল, পুরো জনমানবশূন্য, গা ছমছম করতে লাগলো। হঠাৎ দেখি খুব আধুনিক পোশাক পরে একটি স্মার্ট তরুণী হেঁটে আসছে। তার কাছে আমাদের বিপদের গল্প বলায় সে খুবই চিন্তিত হল, ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে বলল, সে জায়গাটি জানে না বলে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারছে না এবং সেজন্যে সে খুবই দুঃখিত, তবে আমরা চাইলে সে আমাদের একটা ট্যাক্সিতে চড়িয়ে দিতে পারে। আমরা খুবই আহ্লাদিত হলাম। এরকম চেষ্টা আগের মানুষজন যে করে নি তা নয়, আরেকবার দেখা যাক।
এবারেও ব্যাপারটি অত সহজ হল না, ট্যাক্সি-ড্রাইভার এসে পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিন এমন সব প্রশ্ন করতে থাকলো যে আমরা আবার দিশেহারা হয়ে পড়লাম, ওই মেয়েটিও। শেষমেষ সম্বিত ফিরে পেলাম, বললাম যে কোনো একটি আন্ডারগ্রাউন্ড (ট্রেন) স্টেশনে আমাদেরকে নামিয়ে দিতে। ড্রাইভার রাজি হয়ে গেল, তার পক্ষে এটি অনেক সহজ কাজ, আমাদের পক্ষেও সুবিধে স্টেশনে গিয়ে বুঝে শুনে ট্রেন ধরে ইয়ুথ-হস্টেলে চলে যাওয়া। মেয়েটিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কেন যে এই বুদ্ধিটি এতক্ষণ আসে নি !
হস্টেলে ফিরে নাক-কান মললাম। এরপর চিনে যতদিন ছিলাম চৈনিক হরফে লেখা ঠিকানা না নিয়ে এক পা-ও বার হই নি আমরা ঘর থেকে।