ভি ন দে শে । পর্ব ৩
সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।
যদিও ভারতবর্ষের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপদে আমরা বিদেশে ঘুরে বেড়াই, তবুও কিছু কিছু ভয়াবহ ঘটনার মুখোমুখি কিন্তু আমাদেরও হতে হয়েছে। বিদেশে সব-ই কী আর ভালো!
১
প্যারিস কত মানুষের কত স্বপ্নের নগরী, প্যারিসের মানুষের গায়ে কত শিল্পের ছাপ, কিন্তু আজ রাস্তায়-রাস্তায় ভিখারি-পকেটমার-অসাধু-মদ্যপ মানুষের ভিড়। এই দুর্দশার মুখোমুখি আমাদেরকেও দ্বিতীয়বার প্যারিস-ভ্রমণে পড়তে হয়েছে।
নোৎরদাম যাওয়ার মুখে মেট্রো স্টেশনে উঠতে গিয়ে এমন বাধা, অথচ খুব বেশি লোকও যে উঠছে তা নয়। আমাদের সঙ্গে দু’টি অল্পবয়েসী কিশোরী এবং একটি কিশোরও উঠল। কিশোরটি প্রশ্ন করল- কটা বাজে। যদিও ফরাসি ভাষায় প্রশ্ন, কিন্তু সঙ্গে আকার-ইঙ্গিত থাকায় দিব্যি বুঝলাম, ঘড়িটা উল্টে দেখালাম। সেই কিশোর এবং একটি কিশোরী আমাকে এমনই ঘিরে রেখেছে আর সোমা এতই দূরে চলে গেছে, কিছুতেই কেউ কারুর কাছাকাছি পৌঁছাতে পারছি না, অথচ ট্রেনে তেমন ভিড়ও নেই। মনে কু-চিন্তা এলো। হঠাৎ সোমা হৈ-হৈ রৈ-রৈ করে উঠল, ওর পাশের কিশোরীটি হাতে চাদর দিয়ে সমানতালে সোমার শরীর আড়াল করছে কেন! হৈ-হৈ করে সোমা আবিষ্কার করে উঠল, ওর কোমরের পাউচ ব্যাগের চেনটি খোলা। ওর চিৎকারে কিশোর-কিশোরীরা তিনজনই নেমে পড়ল ট্রেন থেকে, তখনও ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে। তৎক্ষণাৎ সোমাও নেমে পড়ল ট্রেন থেকে বিনা বাক্যব্যয়ে। বোঝো কান্ড! অতএব আমাকেও নেমে পড়তে হল। আমরা স্টেশনে নেমে পড়া মাত্র ওই কিশোর-কিশোরী তিনজন একলাফে ট্রেনে উঠে পড়ল ফের এবং তৎক্ষণাৎ ট্রেনটি চলতে শুরু করল। ট্রেনটি বীরবিক্রমে চলেও গেল। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই এমন দ্রুত এত কিছু ঘটে গেল, ট্রেনে উঠে নেমে পড়াটাও ।
সোমার পাউচব্যাগ থেকে কিছুই নিতে পারে নি, কিন্তু নিলে আমাদের দেশে ফেরার টিকিটটি খোয়া যেত, তখন তো এখনকার মতন ই-টিকিট হত না, তা যাই হোক সোমার ব্যাগে আর কিছু মূল্যবান বস্তু অবশ্য ছিল না। হঠাৎই দেখি আমার কোমরের পাউচ-ব্যাগের তিন-তিনটি চেনই খোলা। হায় রে কী হবে! এর মধ্যে আমাদের ডলার পাসপোর্ট সর্বস্ব। ভয়ে এমনই কাঁপছি আমরা যে, ব্যাগটা ফাঁক করে দেখার সাহসটি অবধি নেই। শেষমেষ দেখা গেল সেগুলি সবই রয়েছে, তারা কিছুই নিয়ে উঠতে পারে নি, সোমা খুবই সময়মতন হৈ-হৈ করে উঠেছিল। আমাদের সারা শরীর-মন অবশ, ভেবেই পাচ্ছি না যে কী সাংঘাতিক ঘটনা ঘটতে চলেছিল এই বিদেশ-বিভুঁইতে। ওগুলো সব চলে গেলে কী যে হত! আমরা দেশেই বা ফিরতাম কী করে! কী করতাম! এমনই বিভীষিকাময় ঘটনা ঘটতে চলেছিল, আর কয়েক সেকেন্ড বাদে ঘটেও যেত ঘটনাটি! ভাগ্যিস সোমা আগেই টের পেয়েছিল ষষ্ঠ-ইন্দ্রিয় মাধ্যমে! কলকাতার বাসে-ট্রেনে চড়ে কিছু তো জ্ঞানলাভ হয়েছেই আর তার সুবাদেই ভয়ঙ্কর বিভীষিকা থেকে বেঁচে গেলাম সে যাত্রায়। যদিও আজ অবধি যখনই মনে পড়ে, ভয়ে হিম হয়ে যাই। আমরা ভ্রমণার্থী, আমাদের সঙ্গে এত বড় ঘটনা ঘটতে চলেছিল, এই বিষয়ে স্থানীয় মানুষের ভূমিকাও অতুলনীয়! তাদের মুখে, হাবে-ভাবে কোনোই প্রতিক্রিয়া নেই। ট্রেনের অন্যান্য মানুষেরা যেন সিনেমা দেখছে অথবা তারা যেন নেই-ই সেখানে। কিংবা হয়ত প্রতিনিয়ত দেখতে দেখতে তারা এমনই নির্লিপ্ত হয়ে গেছে।
কলকাতাকে আমরা কলকাতার মানুষেরা কত বিষয়েই কত গালিগালাজ করি, কিন্তু এই যদি ঘটনাটি কলকাতায় ঘটতো, স্থানীয় মানুষের ভূমিকাটি ভাবুন একবার। এমন নয় আমাদের অবলা মনে করে তারা আমাদের সর্বস্ব নিতে সাহস করেছিল, এমনও নয় যে ১৯৯৬ থেকেই হঠাৎ প্যারিসের এমন দুরবস্থা। অন্ততপক্ষে বছর দু’য়েক আগে ১৯৯৪-তেও এমনই দুর্দশা ছিল প্যারিসের। সেবার ‘কসমস’ ভ্রমণসংস্থার সঙ্গে আমরা প্যারিসে গিয়েছিলাম, আমাদের গাইড কার্লো চাবি দিয়ে বাসের দরজা বন্ধ করে আমাদের সবাইকে নিয়ে অপেরার সামনে রাস্তায় নেমে দু’ঘন্টা পরে ফিরে বন্ধ দরজা খুলে বাসে উঠে দেখল যাবতীয় জিনিসপত্রে ভরা তার ব্রীফকেসটি উধাও। সেই থেকে আমরা জানি যে ইউরোপের অন্যান্য দেশ যতই নিরাপদ হোক, প্যারিস মোটেই নয়।