ভি ন দে শে । পর্ব ৭
সম্প্রতি ‘ইতিকথা পাবলিকেশন’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে কবি ঈশিতা ভাদুড়ীর একটি অসাধারণ দু’ ফর্মার ভ্রমণ বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ ‘ভিনদেশে’। একাধিক বিদেশ ভ্রমণের টুকরো অভিজ্ঞতার কিছু অংশ তিনি তুলে ধরেছেন সেখানে। এখানে প্রতি পর্বে আমরা জানব তাঁর তেমনই আরও কিছু দারুণ অভিজ্ঞতার কথা।
হঠাৎ নয়, দস্তুরমতো পরিকল্পনানুসারে কোনও এক সকালবেলায় পৌছে গেলাম ফ্রাঙ্কফুর্টে আমি আর সোমা। মাসটা আগস্ট, hauptbahnhoff স্টেশনে এসে নামলাম সকাল সাতটায়। এই স্টেশনে প্রায় পনেরোশ’ ট্রেন প্রতিদিন চলাচল করে, ভাবা যায় ? অথচ স্টেশনটি প্রথম দৃষ্টিতে দেখে ভাল লাগার কথা নয়, স্টিলের ট্রাস-ওয়ালা পুরোনো ধাঁচের, ওপর থেকে পায়রা কুকর্ম করে যত্র-তত্র। কিন্তু ক্রমে-ক্রমে প্রাগৈতিহাসিক চেহারার মধ্যেও অনেক কিছু দেখতে পাই। হঠাৎ দেখি লিফটের গায়ে উড়োজাহাজের চিহ্ন, এ কী আশ্চর্য! এই লিফটে করে কি সোজা এয়ারপোর্টেই চলে যাওয়া যায়? তখন সুযোগ পাওয়া গেল না, পরে জানতে পারলাম ওই লিফটে করে নিচে নেমে S8 লাইনের ট্রেনে চেপে Flughafen স্টেশনে নেমে সিঁড়ি বা এস্কালেটারে চেপে দিব্যি এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাওয়া যায়। যে-কোনও মানুষই চলে যেতে পারে, অন্তত আমরা চলে গিয়েছিলাম বেড়াতে-বেড়াতে। একেবারে চেক-ইন-কাউন্টার অবধি। ফ্রাঙ্কফুর্টেই জার্মানির সবচেয়ে বড় এবং ব্যস্ত এয়ারপোর্ট। এখানকার ব্যবস্থাদি এতই উন্নতমানের যে শুনেছি মাত্র পঁয়তাল্লিশ মিনিটের ব্যবধানে পরবর্তী প্লেনটি ধরা যায়। পৃথিবীর অন্য কোনও এয়ারপোর্টে সম্ভবত এই সুবিধে পাওয়া যায় না। তা এই Rhein Main এয়ারপোর্টটি মূল শহর থেকে দশ কিলোমিটার দূরে, কিন্তু এত সহজে এত কম সময়ে পৌঁছে যাওয়া যায় যে আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ঈর্ষা হওয়ার কথা।
যাই হোক, যে কথা বলছিলাম, লটবহর নিয়ে স্টেশনে নেমে টাকা ভাঙিয়ে, তখনও ইনফর্মেশন কাউন্টার খোলেনি, এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি, সকাল সাড়ে সাতটায় এত ভিড়, চলল কোথায় সব! ফ্রাঙ্কফুর্টে বহু অফিস সকাল সাড়ে সাতটায় খুলে যায়। ব্যাঙ্ক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলি সাধারণত সকাল আটটায় খোলে, বিকেল চারটেয় বন্ধ। তবে বৃহস্পতিবার সন্ধে ৬টা অবধি খোলা থাকে, কেন না শুক্রবার দুপুর ২টোয় বন্ধ হয়ে যায়। শনি-রবিবারে তো সব উন্নত দেশেই ছুটি থাকে। অতএব কেমন মজা ভাবুন! পুরো আড়াই দিন ছুটি পায় ফ্রাঙ্কফুর্টের মানুষজন। আমরা দেখে হিংসেতে জ্বলে পুড়ে মরতে-মরতে আটটার সময় ইনফর্মেশন কাউন্টার থেকে দুই দিনের কম্বাইনড টিকিট কাটলাম, ১৩ ডয়েস মার্কে দু’দিন যত খুশি ট্রাম-বাস-ট্রেনে চড়া যায়। ওই টিকিটে আবার বেশ কিছু মিউজিয়ামের প্রবেশমূল্যে শতকরা ৫০ ভাগ ছাড় পাওয়া যায়। আমরা সাধারণত কোনও শহরে পৌঁছে সেই শহরের সবচেয়ে সুবিধেজনক টিকিটটি কিনে নিই, যাতে সবচেয়ে কম খরচে সবচেয়ে বেশি বেড়াতে পারি। ফ্রাঙ্কফুর্টে একদিনের কম্বাইনড টিকিটও পাওয়া যায়, তাতে দাম বেশি পড়ে। যেহেতু আমরা চারদিন ছিলাম, আমাদের পক্ষে দু’দিন করে টিকিট কেনাই সুবিধেজনক হয়েছিল। দেশের মানুষেরা বিদেশের গল্প শোনেন যখন, তখন অনেকেই প্রশ্ন করেন—‘কোনও শহরে প্রথমে নেমে কী করতে? ট্যাক্সি করে হোটেল খুঁজতে যেতে?’ এহ বাহ্য! ট্যাক্সি! হোটেল খোঁজা! কী বলে মানুষজন! যেসব মানুষ ভারত থেকে বেড়াতে যায় নিজের পয়সায় শুধুমাত্র বেড়াতে যাওয়ার জন্যই, সেইসব বাজেট ভ্রমণার্থীদের পক্ষে কি বিদেশে ট্যাক্সি চেপে নামী-দামি হোটেল খুঁজতে যাওয়া সম্ভব!
আমাদের তো নির্দিষ্ট ইয়ুথ হস্টেল ছাড়া গতি নেই। কারণ ওই পয়সাটুকু থাকলে আরও কিছু দেখা যায়, আরও একটা শহর। যাই হোক, টিকিট কেটে স্টেশনের বাইরে এসে বৃষ্টি মাখা ফ্রাঙ্কফুর্ট, অস্পষ্ট আকাশ-ছোঁয়া, অদ্ভুত-অদ্ভুত বাড়ি, কোনওটি অর্ধ-নলাকার, কোনওটি শিসকাটা পেন্সিলের মতো, দেখে ভালই লাগল। আমরা ৪৬ নম্বর বাসে করে নদী পার হয়ে ইয়ুথ হস্টেলের দরজায় এসে নামলাম। Main নদীর ধারে হস্টেলটি, এক নজরে চেনার কথা নয়। সাধারণভাবে হস্টেলগুলির মাথায় পতাকার চিহ্ন থাকে। এই ইয়ুথ হস্টেলটিতে কোনও চিহ্ন নেই। জার্মান ভাষায় অবশ্য কী সব লেখা আছে, অন্য ভাষী মানুষেরা কেমনভাবে বুঝবে তা জানি না। Frankensteiner Platz স্টপে নেমে পড়লাম। ওই দেশে অজানা মানুষের পক্ষে যে কোনও স্টপে বাস বা ট্রাম থেকে নামা কোনও অসুবিধেই নয়। যাত্রীদের সামনে ইলেকট্রনিক বোর্ডে স্টপ আসার আগে তার নাম লেখা হয়ে যায়। যাই হোক, ইয়ুথ হস্টেলে পৌঁছলাম। ১৯৯৬-এর কথা, তখন ২৮ ডয়েস মার্কে থাকা এবং প্রাতঃরাশ। সাধারণত ইয়ুখ হস্টেলগুলিতে রান্নার সুবন্দোবস্ত থাকে, কিন্তু এই হস্টেলটিতে ছিল না। অতএব প্রাতঃরাশ ছাড়া অন্য খাবারগুলির জন্য দোকানই ভরসা, দেখে-শুনে বাজেট মতো কিনে নেওয়া ছাড়া উপায়-ই বা কী!
মাইন নদীর দুই পাশে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরটি গড়ে উঠেছে। নদীর ধারটি সুন্দরভাবে বাঁধানো, ঘাসের পাশে বসার চেয়ার, রাস্তায় মানুষজন কেউ হাঁটে, কেউ ছোটে, কেউ সাইকেলে বেড়ায়, নদীতে বোটিং করার সুবন্দোবস্ত আছে। ওপরের ধাপে রাস্তা বাস চলাচলের জন্য, পাশে ঘর-বাড়ি, ইয়ুথ হস্টেল, সারি-সারি মিউজিয়াম।
যদিও প্রতিদিন ফ্রাঙ্কফুর্ট শহর নতুন করে তৈরি হচ্ছে, দৈর্ঘ্যে এবং নকশায় বদলে যাচ্ছে, আজকের শহরকে পাঁচ বছর বাদে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব, তবুও ফ্রাঙ্কফুর্টেরও নিজস্ব কিছু অতীত ইতিহাস রয়েছে। মাইন নদীর ওপর একটি সরু ব্রিজ থেকে এই শহরের নামের উৎপত্তি। ফ্রাঙ্করা আসার বহু আগেই এখানে বসতি শুরু হয়েছে। পুবদিকের বন্দর তৈরির সময় থেকেই প্রস্তরযুগের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যায়। রোমানরা একটি ব্রিজ ও একটি দুর্গ বানিয়েছিল প্রথম খৃস্টাব্দে। তারপর থেকে অনেকে, শেষমেষ ফাঙ্করা বসতি শুরু করে।
১২৪০ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলার সূচনা হয়। এখন আন্তর্জাতিক শারদমেলা হয় শহরের মেলা প্রাঙ্গণে। ১৩৩০ খ্রিস্টাব্দ থেকে বসন্তেও মেলা আরম্ভ হয়। ১৪০৫ খৃস্টাব্দে দুটি দোকান Romer এবং Goldener Schwan কে নিয়ে টাউন হল তৈরি হয়, ক্রমে বিস্তৃত হয়। ১৬০০ খৃস্টাব্দে ফ্রাঙ্কফুর্টে মুদ্রা তৈরির দায়িত্ব আসে, তখনই জার্মান এক্সচেঞ্জ স্থাপিত হয়। ধীরে-ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্যের রমরমা অবস্থা হয় এবং অনেক ব্যাঙ্ক তৈরী হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শহরের প্রাণকেন্দ্রটি বিমান-আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। ফ্রাঙ্কফুর্ট নতুন করে গড়া হল সিমেন্ট আর কাচ দিয়ে, যা সাধারণত অন্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরগুলিতে হয়নি। পুরোনো দিনের স্থাপত্যের নিদর্শন দেখাতে পাওয়া যায় কাঠের বাড়িগুলোয় এবং চারটি ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের মিনারে।
সকালবেলায় ইয়ুথ হস্টেলে মালপত্র রেখে রাস্তায় নেমে পড়লাম। ইয়ুথ হস্টেলে থাকলে নদীর দক্ষিণ ধার ধরে-ধরে মিউজিয়ামগুলি প্রথমে দেখে নেওয়া ভাল। সাত সাতটি মিউজিয়াম। প্রথমে অ্যাপ্লায়েড আর্টসের মিউজিয়াম, মার্কিন স্থপতি রিচার্ড মেয়র নকশা করেছিলেন। আমেরিকান ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্টস ১৯৭৮-এ পুরস্কৃত করেছিল এই বাড়িটিকে। মূল বাড়িটি কৌণিক, খুবই আলোময়, সংশ্লিষ্ট অন্য বাড়িটিতে ইউরোপ এশিয়ার মধ্যযুগ থেকে বিংশ শতাব্দীর ত্রিশ হাজার কারিগরির নমুনা রয়েছে। মিউজিয়ামের সংলগ্ন কফির দোকানে মানুষেরা খুবই ভিড় করে বসে রোদ পোহায়। এরপরে যে মিউজিয়ামটি সেটি মানবজাতি তত্ত্ব সংক্রান্ত। এই মিউজিয়ামটির ১৯৪৪ খৃস্টাব্দে বোমায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এখানে রিসেপশানে যে মেয়েটি বসেছিল তার হাতে রোটরিং কলম দেখে খুবই কৌতূহলী হয়ে পড়েছিলাম। জার্মানির এই কলমণ্ডলি দেশে আমার খুবই কাজে লাগে (তখনও অটোক্যাডের ব্যবহার আরম্ভ হয়নি আমাদের অফিসে)। দামে সস্তা হলে কেনা যেতে পারে ভেবে দোকানের নাম-ঠিকানা জেনে নিলাম। যদিও সে আমাদের যা বোঝাল আমরা কিছুই বুঝলাম না। অবশ্য সে নাম-ঠিকানা একটি কাগজে লিখে দিল। বলা বাহুল্য, ওর লিখে দেওয়া সেই দোকানটি খুবই বড়। সেই দোকানে এবং আরও অন্য দোকানে ওই কলমের খোঁজ করে জানতে পারলাম কলকাতার চেয়ে পাঁচগুণ দাম বেশি। এই বিষয়টিতে আমি এত আশ্চর্য হলাম, যদিও দোকানীরা আমার কথা শুনে বিশ্বাস করলো না মোটেই, অবিশ্বাসী ভঙ্গিমাতে তাকিয়ে রইল।
ক্রমশ…