আমরা পরদিন সকালবেলায় Alte Oper-এ গেলাম। এটি পুরনাে অপেরা হাউস। আমরা এমন সময়ে গিয়েছিলাম যে তখন বাড়িটিতে মেরামতির কাজ চলছে। শুধু ওই বাড়িটিতে নয়, ফ্রাঙ্কফুর্টের অধিকাংশ বাড়িতে, শুধু ফ্রাঙ্কফুর্টে নয় প্যারিসে লন্ডনে যেখানে-যেখানে গিয়েছি সব জায়গাতেই মেরামতির কাজ লক্ষ করলাম; ফলে চিন্তা এসে যায়; এই বছরটি মেরামতি বর্ষ নাকি, যেমন নারী-বর্ষ, শিশু-বর্ষ হয়! তা যাই হােক, মূল অপেরা হাউসটি এতই সুন্দর যে এটি ড্রেসডেন বা প্যারিসের অপেরা হাউসের হিংসার কারণ হতে পারে। ১৮৮০-র ২০ অক্টোবর এই অপেরা হাউসের উদ্বোধন এতই জাঁকজমক করে হয় যে অতীতের রাজ-অভিষেক অনুষ্ঠানও হার মেনে গিয়েছিল। ১৯৪৪-এর বােমাবর্ষণে এটি নষ্ট হয়ে যায়। ১৯৮১-তে পুনরায় চালু হয়। ১৯৮৭-তে একটি উন্মাদ এতে আগুন লাগায় এবং পুনর্নির্মাণ করতে তিন বছর সময় লেগেছিল। এখানে জ্যাজ ও নানারকম সঙ্গীত-অনুষ্ঠান হয়। বেসমেন্টে রেস্টুরেন্ট এবং গাড়ি রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। Alte Oper-এর সামনে একটি সুন্দর পার্ক রয়েছে, সেখানে সারাদিন বাচ্চা-বুড়াে সকলের ভিড় হয়, মানুষজন রােদ পােহায়।
এই Alte Oper থেকে দূরে টেলি কমিউনিকেশনের মিনার দেখা যায়, সুচের মতাে সরু মাথাটিই সেখান থেকে দেখা যায়। পরে ব্যাড হ্যামবার্গ নামে একটি মফস্বল অঞ্চল থেকে ফেরার পথে ট্রেনের জানলা দিয়ে ওই মিনারের মাথা ছাড়া অন্যান্য অংশও দেখতে পেয়েছিলাম। ৩৩০ মিটার উঁচু এই টাওয়ারটি নাকি পশ্চিম জার্মানির সবচেয়ে উঁচু।
ফ্রাঙ্কফুর্টে বিরাট-বিরাট দোকান। একটি দোকানের চারদিকে প্রবেশপথ। আন্ডারগ্রাউন্ড স্টেশনে একটি দরজা। দোকানটিতে অ আ ক খ সবই পাওয়া বায়। আমরা জিনিস দেখতে ব্যস্ত। হঠাৎ আমরা দেখলাম, একজন মধ্যবয়সি খুবই ভদ্রজনােচিত মানুষ, ভাল জামা-কাপড়-টাই পরে মন দিয়ে সিডি ক্যাসেট দেখছিল, হঠাৎ একটি ক্যাসেট নিয়ে দরজা দিয়ে দ্রুতগতিতে হেঁটে বার হয়ে গেল সাবওয়ে স্টেশনের দিকে। আমি আর সােমা দুজনেই দেখলাম, আরও কেউ কেউ হয়তাে দেখেছিল; দোকানিরা নিশ্চয় কেউ দেখেনি, যদিও চারদিকেই ক্লোজ সার্কিট টিভি র ক্যামেরা। আমি সােমা আমরা তৃতীয় বিশ্বের মানুষ, ইউরােপীয় মানুষের এরকম আচরণে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কথা, না, আনন্দিত হওয়ার কথা?
সেন্ট্রাল রেল স্টেশনের সামনে থেকে ১৯ নম্বর ট্রামে করে Messe-তে যাওয়ার পথে ট্রামে হঠাৎ শুদ্ধবাংলা কথা কানে এল, ‘আপনারা ভারতীয়?’ হঠাৎ অনেকদিন পর নিজের ভাষা শুনলে কার না ভাল লাগে! পরিচয়ে জানা গেল, তিনি বাংলাদেশি, বাংলাদেশ বিমানে কর্মরত। আমরা দুটি না-বৃদ্ধা মহিলা বিদেশে না-জানা মানুষের সঙ্গে পরিচয় থেকে আলাপে যেতে চাইনি।
অতএব ট্রাম থেকে নেমে আমরা আমাদের গন্তব্যে, বিরাট মেলা প্রাঙ্গণ, এখানে বিশ্ব বাণিজ্য মেলাটি হয়, এলাহি ব্যাপার, যদিও আমরা মেলার সময় যাইনি। দুপুরবেলার খা-খা রােদে মাইল-মাইল হেঁটে দেখি Messe-র এপ্রান্ত থেকে সেপ্রান্ত। Festhalle-এর যে ছবিটি আমরা দেখেছিলাম ফ্রাঙ্কফার্টে রওনা হওয়ার আগে সেটি ১৯৮৮ কি ১৯৮৯-এর—ছবির সেই বাড়িটির সঙ্গে আমাদের চোখে দেখা বাড়িটির অনেক তফাত, যদিও তখনও বাড়িটি গােল এবং যথেষ্ট বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এখানে সপ্তাহে দুদিন কনসার্ট ইত্যাদি হয়। এই হলটিতে নাকি বারাে হাজার মানুষ একসঙ্গে জমায়েত হতে পারে। ফ্রাঙ্কফুর্টে যাওয়ার আগে পড়েছিলাম ২৪ তলা Torhaus বাড়িটি Messe তে জাতীয় সুবর্ণ পদক পেয়েছে স্থাপত্যের জন্য। সেই বাড়িটিকে দেখার জন্যে হেঁটে হেঁটে আর কুল পাই না, শেষে বাড়িটিকে পাওয়া গেল যদিও চেহারায় আমূল বদল। সেই বাড়িটি দেখে এমনই বিভাের যে ভুল রাস্তায় হাঁটা লাগিয়েছি। ওইসব দেশে একবার ভুল রাস্তায় গেলে আর রক্ষে নেই, বিশাল নাকানি চোবানি খেয়ে তবেই ঠিক রাস্তায় ফেরা যায়। সােমা আমাকে সমানে বোঝানোর চেষ্টা করছে এটা শহরের রাস্তা নয়, ডানদিকে গেলে শহরে যাওয়া যাবে, আমরা নিশ্চয়ই অন্য কোথাও চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমি তাে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বােদ্ধা, অতএব আমি কিছুতেই বুঝবো না। আমার বক্তব্য ছিল এই রাস্তা শুধু বাঁদিকেই যাবে কে বলল, ডাননিকেও নিশ্চয়ই যাবে। কিন্তু না, সত্যিই ওই রাস্তাটি শুধু বাঁদিকেই গিয়েছিল। সোমার কথা না শুনে ওই রাস্তা ধরে হাঁটলে সম্ভবত আমরা Bockenheim অঞ্চলে চলে যেতাম।
আমাদের বছর দুয়েক আগে জার্মানিতে গিয়ে রাইন নদীর বুকে বেড়ানাের স্মৃতি এমনই মধুর যে এবারে দুদিন ধরে জার্মানিতে এসেও সেই নদীর দেখা না মেলায় মনটা হু হু করে উঠল। তৃতীয় দিনেই সম্ভবত রাইনের টানে এয়ারপাের্ট ছাড়িয়ে চলে গেলাম উইসবাডেনে S৪ লাইনের ট্রেনে করে। Maing Sind স্টেশনের গায়েই আমরা রাইন আর মাইন এই দুই নদীর সংযােগ দেখতে পেলাম। উইসবাডেন থেকে ফেরার পথে অন্য লাইনের ট্রেন ধরে অন্যদিকে দিয়ে ফিরেছিলাম—সে ট্রেন যায় আমাদের জনতা এক্সপ্রেসের চেয়েও খারাপ এবং সে ট্রেনে লােক নেই বললেই চলে। পুরাে ট্রেনে সম্ভবত ১০ থেকে ১৫ জন লােক। আমাদের কম্পার্টমেন্টে আমরা দুজন, ভয়ে গা ছমছম করার অবস্থা। ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরকে দুদিন ধরে যতটুকু দেখেছি তাতে খুব একটা নির্ভেজাল মনে হয়নি। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সন্দেহজনক মানুষকে বেশ ভালই দেখা যায়। সাবওয়েতে বা স্টেশনের চারপাশে বা খুব ব্যস্ত এলাকায়ও যখন ভিড় কমে যায় তখন নেশাগ্রস্ত সন্দেহজনক মানুষজন দেখা যায়। তাদেরকে এড়িয়ে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
আমরা শুক্রবারে একটি এলাকায় গিয়েছিলাম, Hauptwache র কাছাকাছি Fressgass-এর দিকে, সেখানে প্রতি শুক্রবারে হাট বসে। বই থেকে আরম্ভ করে ছুরি কাঁচি, জামাকাপড়, খাদ্যবস্তু সবই পাওয়া যায়। হঠাৎ দেখি একটি স্টলের সামনে খুব ভিড়, বিক্রেতা গরম-গরম কী যেন ভাজছে! সােমা তীক্ষ্ণ চোখে দেখে নিয়েছে বস্তুটি আলু। আমরাও দাঁড়িয়ে গেলাম জার্মানদের সঙ্গে—নির্ভেজাল আলুর বড়া। খুবই বড়-বড়, সঙ্গে আবার আপেলের সস, জার্মান মানুষেরা দেখলাম খুবই খাদ্যরসিক!